সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:২৪:৩৯

রাজনীতি ছাড়া আমাদের চলে না কেন?

রাজনীতি ছাড়া আমাদের চলে না কেন?

বিশ্বজিৎ চৌধুরী : ৩৩টি দেশের মধ্যে জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের অবস্থান এক নম্বরে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসে মার্কিন গবেষণা সংস্থা পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে এ তথ্য উঠে এসেছে।

জরিপ কেন, এ দেশে বাস, ট্রেন বা যেকোনো গণপরিবহনে যাত্রীদের আলাপ-আলোচনা বা আড্ডা-তর্কের বিষয় লক্ষ করলে বোঝা যাবে, সাধারণ মানুষের প্রিয় বিষয় ‘রাজনীতি’। সরকারবিরোধী দল, নেতা-নেত্রীর পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল তর্কে আসর জমিয়ে তুলতে ভালোবাসে সব বয়সের, সব শ্রেণির ও পেশার মানুষ। এমনকি ফেসবুকের মতো যোগাযোগমাধ্যমেও দেখা যায়, সাম্প্রতিক সময়ের যেকোনো রাজনৈতিক ইস্যুই এখানকার মানুষের উদ্বেগ ও আলোচনার বিষয়।

সম্প্রতি মার্কিন প্রতিষ্ঠানের এই জরিপ পর্যালোচনা করে সাংবাদিক এ কে এম জাকারিয়া দেখিয়েছেন উচ্চ, মধ্যম ও নিম্ন—এসব পর্যায় মিলিয়ে বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষেরই রাজনীতিতে অংশগ্রহণ রয়েছে। তাঁর লেখার শিরোনাম ছিল ‘রাজনীতি ছাড়া আমাদের চলেই না’ (প্রথম আলো, ৩ সেপ্টেম্বর)। তাঁর এই লেখার সূত্র ধরেই এ প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক, রাজনীতি ছাড়া আমাদের চলে না কেন? তাহলে শুধু উদ্বেগ বা সচেতনতার বিষয় নয়, রাজনীতি কি আসলে আমাদের বিনোদনেরও উপকরণ হয়ে উঠেছে?

এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে প্রথমেই খোঁজ নিতে হবে আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের জন্য বিনোদনের আয়োজনই-বা কতটা আছে। মোটা দাগে মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা হিসেবে আমরা যে উপাদানগুলোর কথা ভাবি, তার মধ্যে খেলাধুলা, সিনেমা, টেলিভিশন, পর্যটন ইত্যাদি প্রসঙ্গ আসে সবার আগে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য সহশিক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপারও আসে। কথা হচ্ছে, চাহিদার তুলনায় এর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কি না।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সাধারণ মানুষের প্রধান বিনোদনের মাধ্যম চলচ্চিত্র। সে দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বিশাল অর্থনৈতিক লেনদেনই প্রমাণ করে যে এই বিনোদনমাধ্যম নিয়ে কতটা আগ্রহ ও কৌতূহল রয়েছে তাদের মধ্যে। দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ইউরোপ-আমেরিকা পর্যন্ত ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির হাত এখন প্রসারিত। স্বাভাবিকভাবে সেই ঢেউ আমাদের দেশেও এসে পড়েছে। আমাদের দেশে কেন, আজ এমনকি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মানুষের কাছে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহের রাষ্ট্রপ্রধানের নাম যতটা পরিচিত, তার চেয়ে শাহরুখ-সালমান বা আমির খানের পরিচিতি অনেক বেশি।

আমাদের দেশে চলচ্চিত্রশিল্প বলা যায় টিম টিম করে জ্বলছে। ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট করপোরেশন (এফডিসি) আছে, সেখানে নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি ও পর্যাপ্ত কারিগরি সুবিধা। তার মধ্যেও নির্মিত হচ্ছে ভালো-মন্দ ছবি। এমন প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মেধাবী কিছু তরুণ ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে দেশি বা আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্তির খবরও পাচ্ছি আমরা। কিন্তু ভালো সিনেমা হলের অভাবে ভিন্ন ধারার এসব চলচ্চিত্র তো দূরে থাক, দেশীয় মূলধারার ছবি দেখারও সুযোগ পাচ্ছে না দর্শক। সারা দেশে সিনেমা হলের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে।

মিলনায়তন ভেঙে গড়ে উঠছে মার্কেট বা বহুতল ভবন। এককালে সপরিবারে সিনেমা হলে যাওয়ার রেওয়াজ ছিল। অথচ আজ দেখা যাচ্ছে যে অধিকাংশ পরিবারের নবীন সদস্যেরই সিনেমা হলের বড় পর্দাটি দেখার সুযোগ হয়নি। দেশে যে কটি হল এখনো আছে, তার হতদরিদ্র চেহারা, অস্বস্তিকর পরিবেশ, দুর্বল প্রদর্শনব্যবস্থা ইত্যাদির কারণে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত দর্শকেরা হলবিমুখ। রাজধানী ঢাকা ছাড়া সিনেপ্লেক্স বা ভালো সিনেমা হল নেই। চট্টগ্রাম বা সিলেটের মতো তুলনামূলক সচ্ছল নাগরিকের শহরে যেকোনো শিল্পোদ্যোক্তা একটি মানসম্মত সিনেমা হল নির্মাণের উদ্যোগ নিলেন না, এটা রীতিমতো বিস্ময়কর।

গ্রামগঞ্জে কিছুদিন আগেও নির্দিষ্ট মৌসুমে নিয়মিত যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। পাড়াগাঁয়ের লোকজন, এমনকি বউ-ঝিরাও যাত্রাদলের আগমনের অপেক্ষায় দিন গুনত অধীর আগ্রহে। সেই দিন আর নেই। কট্টর মৌলবাদীদের হুমকি-ধমকি এবং সংস্কৃতিবিমুখ স্থানীয় প্রশাসনের প্রবল বাধার কারণে ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বা গেছে যাত্রাশিল্প। অশ্লীলতার অভিযোগে যাত্রাশিল্পকে ধ্বংস করা হয়েছে। অথচ গ্রামগঞ্জে অমুক মেলা, তমুক মেলার নামে জুয়া বা অশ্লীল নাচ-গানের আসর বন্ধ করা যায়নি।

টেলিভিশন এ যুগে সবচেয়ে বড় বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। অথচ বাংলাদেশে প্রায় ৩০টি টিভি চ্যানেল আকৃষ্ট করতে পারল না বিনোদনপ্রত্যাশী মানুষকে। ভারতীয় চ্যানেলগুলোর দাপট এখানেও। আসলে গান, নাটক, ধারাবাহিক নাটক, রিয়েলিটি শো ও ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নিয়ে পুরোপুরি বিনোদননির্ভর একটি চ্যানেলও নেই এ দেশে। যেসব চ্যানেল সংবাদ ও সংবাদনির্ভর, তাদের কথা আলাদা, কিন্তু মিশ্র চ্যানেলগুলোতে দু-একটা নাটক বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান যা-ও হয়, তা হারিয়ে যায় সংবাদ, টক শোর ভিড়ে বা বিজ্ঞাপনের আধিক্যে। এতে ভালো অনুষ্ঠানের নির্মাতারাও হতাশ। অধিকাংশ প্রতিভাবান নির্মাতা এখন বরং অধিক মনোযোগী বিজ্ঞাপন নির্মাণে। আমাদের ধারণা, সংবাদ চ্যানেল ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের চ্যানেল যত দিন আলাদা না হচ্ছে, তত দিন এ অবস্থা চলতেই থাকবে।

ভারতে এনডিটিভি, জি নিউজ, টাইমস নাউ, আজতক প্রভৃতি চ্যানেল সংবাদ ও সংবাদ-বিশ্লেষণ প্রচার করে, কিন্তু সে দেশের বড় বড় ঘটনা-দুর্ঘটনার সময়ও সনি, স্টার, সেট ম্যাক্স বা কালারস টিভিকে এসব বিষয়ে উদ্বিগ্ন দেখা যায় না। এসব চ্যানেল তাদের দর্শকদের মনোরঞ্জন নিয়েই ব্যস্ত থাকে। বাংলাদেশের অধিকাংশ টিভি দর্শক যেখানে জি বাংলা বা স্টার জলসার অনুষ্ঠানে বুঁদ হয়ে আছে, সেখানে দেশীয় চ্যানেলগুলো কেন সংবাদ ও রাজনীতিনির্ভর টক শো প্রচারে অধিক আগ্রহী, এ এক অমীমাংসিত প্রশ্ন। সরকার প্রতিটি চ্যানেলের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংবাদ প্রচার বাধ্যতামূলক করেছে।
বিনোদননির্ভর কোনো চ্যানেল যদি নিজেরা সংবাদ প্রচারের উদ্যোগ না নেয়, তাদের ক্ষেত্রে সরকারের বাধ্যবাধকতাও শিথিল করা উচিত। তবে বেশির ভাগ চ্যানেলই তো সংবাদবিষয়ক অনুষ্ঠান ও বিনোদন অনুষ্ঠানের জগাখিচুড়ি। দিনের যেকোনো সময় রিমোট টিপলেই গান-নাচ-নাটক ইত্যাদি উপভোগের যদি নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে জি বাংলা, স্টার জলসা বা অন্যান্য ভারতীয় চ্যানেলের ওপর দর্শকের নির্ভরশীলতা কমবে বলে মনে হয় না, তা সে যতই ‘বিজাতীয়’ সংস্কৃতি হোক না কেন। অন্যদিকে সংবাদ বিশ্লেষণ বা টক শোর দর্শকেরা রাজনীতিতে আসক্ত হয়ে পড়বেন এবং রাজনীতিই তাঁর বিনোদনের বিষয় হয়ে উঠবে, এটাই তো স্বাভাবিক।

তরুণদের একটি বড় অংশ সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান-গবেষণা প্রভৃতি সৃজনশীল কাজে এগিয়ে এলে একটি বহুমাত্রিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে, যা দেশকে এগিয়ে দিতে পারে আমাদের স্বপ্নের সমান দূরত্বে

খেলাধুলার বিষয় যদি বলি, দেশের বড় বড় শহরে শপিং মল ও বহুতল ভবনের ভিড়ে খেলার মাঠ প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। শহুরে শিশু-কিশোর-যুবকেরা খেলাধুলায় অংশগ্রহণকারী নয়, দর্শকমাত্র। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সাফল্যে উজ্জীবিত তরুণদের পতাকা হাতে উচ্ছ্বাস করতে দেখা যায়, বল-ব্যাট নিয়ে মাঠে নামার সৌভাগ্য তাদের কজনের হয়? শহরের ছোট একটি মাঠকে ভাগাভাগি করে অন্তত ১০টি দলের শ খানেক তরুণকে যখন খেলতে দেখি, তখন বুকের ভেতর হাহাকার জাগে। এদের শৈশবের আনন্দের পরিসর কত ক্ষুদ্র হয়ে গেছে!

দেশের কটি স্কুল-কলেজে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়, কটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, বার্ষিক ম্যাগাজিন এমনকি দেয়ালপত্রিকা প্রকাশিত হয়, তার একটি জরিপ করলে যে হতাশাজনক চিত্র উঠে আসবে, এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। শরীর-মনের প্রফুল্লতা না থাকলে তরুণের অলস মস্তিষ্ক শয়তানের (পড়ুন রাজনীতির) কারখানা হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে বলা হয়েছে, রাজনীতিতে বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণ বেশি। রাজনীতিতে বেশি মানুষের অংশগ্রহণ ভালো না খারাপ—এ সম্পর্কে অবশ্য জরিপে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। তবে আমাদের সাধারণ বিবেচনা বলে, কোনো কিছুরই আধিক্য সমাজের জন্য সুফল বয়ে আনে না।

৬৫ শতাংশ মানুষ উচ্চমাত্রায় রাজনীতিতে অংশ নেয়—এ তথ্যটি উদ্বেগজনক। আমাদের দেশের রাজনীতি মাঝেমধ্যেই সংঘাতমুখর হয়ে ওঠে। তখন এই ‘উচ্চমাত্রা’র অংশগ্রহণকারীরা দেশের পরিস্থিতিকে বিপজ্জনক দিকে ঠেলে দেয় কি না, সেটা ভাবার সময় এসেছে। কেননা, নিকট ও দূর অতীতে এমন অনেক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে আমাদের। এ ছাড়া যেকোনো বিষয়ের পরিমাণগত আধিক্য তার গুণগত মান হ্রাস করে—এ তো সাধারণ সূত্র। হয়তো তাই আজ ছাত্ররাজনীতি টেন্ডার দখলের, শিক্ষক-রাজনীতি শিক্ষার্থীদের বিড়ম্বনার, পরিবহন শ্রমিকের রাজনীতি চাঁদাবাজির এবং চিকিৎসকের রাজনীতি রোগীদের ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠেছে।

দেশের মানুষ রাজনীতিবিমুখ হয়ে পড়ুক, এ কথা বলি না। কিন্তু রাজনীতিই বিনোদনের মাধ্যম হয়ে উঠবে, এটা কাম্য হতে পারে না। বরং সুস্থ ধারার বিনোদনের প্রসার ঘটুক। তরুণদের একটি বড় অংশ সাহিত্য-সংস্কৃতি, খেলাধুলা, প্রযুক্তি, বিজ্ঞান-গবেষণা প্রভৃতি সৃজনশীল কাজে এগিয়ে এলে একটি বহুমাত্রিক সমাজ গড়ে উঠতে পারে, যা দেশকে এগিয়ে দিতে পারে আমাদের স্বপ্নের সমান দূরত্বে।-প্রথমআলো
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]
১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে