শনিবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:০৪:৪৯

ভ্যাট ইস্যুতে সংকট আরও ঘনীভূত

ভ্যাট ইস্যুতে সংকট আরও ঘনীভূত

মুসতাক আহমদ : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর বসানো ভ্যাট নিয়ে সংকট কাটছে না। উল্টো অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সমস্যা আরও জটিল হওয়ার আশংকা রয়েছে। শিক্ষার্থীরা ভ্যাট না দেয়ার দাবিতে লাগাতার কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি দেয়ার কথা ভাবছে। ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আসে।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত শুক্রবার ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁওয়ের এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের বলেন, এ বছর ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় যাতে এ ভ্যাট শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় না করে, সেজন্য সরকার মনিটরিং করবে। কিন্তু আগামী বছর থেকে শিক্ষার্থীদের অবশ্যই ভ্যাট দিতে হবে। ভ্যাট এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষার্থীদের প্রতিদিনের ব্যয় ১ হাজার টাকা। এখান থেকে মাত্র ৭৫ টাকা ভ্যাট চাচ্ছেন বলে জানান তিনি।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর ভ্যাট ইস্যুতে অর্থমন্ত্রী হার্ডলাইনে যাওয়ায় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তারা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ডাক দিয়েছে। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অবস্থান, কোথাও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করবে বলে জানা গেছে।

শুক্রবার শিক্ষার্থীরা ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনে তারা দাবি করে, শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে নয়, শিক্ষা খাত থেকেই ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে। এজন্য তারা রোববার থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগাতার ধর্মঘটের ঘোষণা দেয়। তারা বলে, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। শিক্ষার্থীরা বলেন, জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা রাস্তায় নামব না। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসে থাকব। সেখানে বসে ধর্মঘট পালন করব।

এর আগে ছাত্রদের ভ্যাট দিতে হবে না- বৃহস্পতিবার সরকারি এমন ঘোষণায় অনেকের মাঝেই আশার আলো উঁকি দেয়। ফলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের অনেকেই অবরোধ তুলে ঘরে ফেরে। কিন্তু শুক্রবার হঠাৎ করেই সেই আলো যেন নিভে যায়। আগের দৃশ্যপটে ফিরে যাওয়ার সংকল্প ঘোষণা করে শিক্ষার্থীরা। তিনটি গ্র“প আলাদা সংবাদ সম্মেলনে ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে তারা দাবি আদায়ে আলটিমেটাম দিয়ে ধর্মঘটের ডাক দেয়।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিক সমিতি ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। তারা সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের ওপর এখন আর কোনো ভ্যাট নেই। ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু ‘অলাভজনক বা ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভ্যাট বা ট্যাক্স কোনোটিই বসতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে তারা ভ্যাট প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ ভ্যাট প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরাও ভ্যাট প্রত্যাহারের আহ্বান জানান।

এদিকে ‘ভ্যাট শিক্ষার্থীদের দিতে হবে না, বিশ্ববিদ্যালয় দেবে’- সরকারের এমন ঘোষণার মধ্যে ‘ফাঁকি’ আছে বলে মনে করছেন ভ্যাট বিশেষজ্ঞরা। এ কারণে তারা এনবিআরের ব্যাখ্যার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তারা বলেন, এটা সঠিক কোনো ঘোষণা বা বক্তব্য নয়। ভ্যাটের সংজ্ঞা বা ধারণার সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। আন্দোলন প্রশমনের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে এ ঘোষণা দেয়া হয়েছে বলেও মনে করেন তারা।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজনেস স্টাডিজ অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. শিবলি রুবাইয়াতুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, ‘এনবিআর যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা ভুল। ভ্যাট হচ্ছে ব্যক্তি যে ভ্যালু (মূল্য বা সেবা) নেবে তার ওপর ‘অ্যাডেড’ (সংযুক্ত) যে ট্যাক্স হবে, সেটাই ভ্যাট। সেই হিসেবে শিক্ষার্থী যদি ১০০ টাকার শিক্ষা নেয়, সঙ্গে সাড়ে ৭ টাকা ট্যাক্স দেবে- সেটাই ভ্যাট। এটি বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে দিবে, তা আমি বুঝতে পারছি না। এছাড়া শিক্ষা তো কোনো পণ্য নয়।

শিক্ষার্থীরা কেন তা দেবে?’ তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় যদি আয়ের বিনিময়ে কিছু দেয়, সেটাকে ট্যাক্স বলা যেতে পারে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভ্যাট কীভাবে দেবে?’

চলতি বছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর সরকার সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করে সরকার। গত জুনে বাজেট উপস্থাপনকালে অর্থমন্ত্রীর প্রথম ঘোষণায় ১০ ভাগ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাব ছিল। আপত্তি উঠলে পরে তা সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়।

বাজেট পাসের পর থেকে শিক্ষার্থীরা ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আন্দোলন করে আসছে। বুধবার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা এমনই একটি কর্মসূচি পালন করছিল। কিন্তু ওইদিন পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। এরপরই আন্দোলন বড় আকার ধারণ করে। বৃহস্পতিবার বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ঢাকার অন্তত ৯টি পয়েন্ট দখল করে দিনভর বিক্ষোভ চালায়। এতে সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট। ফলে রাজধানী কার্যত অচল হয়ে পড়ে। এ বাস্তবতায় বৃহস্পতিবার বিকালে অর্থমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, ‘ভ্যাট প্রত্যাহার হবে না। তবে শিক্ষার্থীদের ভ্যাট দিতে হবে না। ভ্যাট দেবে বিশ্ববিদ্যালয়।

রাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে নিজের ভাষণেও একই ধরনের কথা বলেন। এর আগে সন্ধ্যা ৬টার দিকে এনবিআর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি করে। সেখানেও একই ধরনের নির্দেশনা ছিল। পাশাপাশি ‘গভর্নমেন্ট ইনফো’ (সরকারি তথ্য) নামে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে এসএমএস দেয়া হয়। তবে এনবিআরের বিজ্ঞপ্তি আর এসএমএসে প্রকাশিত তথ্যে এ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। ভ্যাট কে দেবে- সেই প্রশ্নও ফিরছিল অভিভাবক, শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এমনকি এনবিআরের ব্যাখ্যা নিয়ে সচেতন মহল বিশেষ করে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে ‘কৌতুকের’ সৃষ্টি হয়। শুরু হয় নানা পর্যালোচনা।


ভ্যাটবিরোধী এ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের বিশিষ্ট নাগরিক এবং রাজনীতিবিদরাও মুখ খুলেছেন। তাদের কেউ কেউ ভ্যাট আরোপের বিষয়টির সমালোচনা করেন। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এক সংবাদ বিবৃতিতে বলেছেন, ‘শিক্ষা খাতে ভ্যাট আরোপ করায় এটাই প্রমাণিত হয় যে, সরকার শিক্ষার অগ্রগতি চায় না। আরোপিত এ ভ্যাটের ফলে বেসরকারি শিক্ষা কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হবে। কারণ ভ্যাট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর চাপিয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও পরোক্ষভাবে তা ছাত্রছাত্রীদের ওপরই বর্তাবে।


আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত শুক্রবার রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে এক আলোচনা সভায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের উদ্দেশে বলেন, এখন তারা যথেষ্ট লাভ করছেন। লাভ করবেন কিন্তু ভ্যাট দিবেন না, তা তো হতে পারে না। মালিক অসুবিধায় পড়লে ছাত্রদের রাস্তায় নামিয়ে দেবেন, তা তো হতে পারে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন আর অলাভজনক নেই বলেও মনে করেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি সরকারকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, মালিকপক্ষ যাতে ভ্যাটের জন্য অতিরিক্ত টাকা আদায় করতে না পারে সেজন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদারকি বাড়ানো দরকার।

বিএনপির পক্ষে বৃহস্পতিবারই আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়েছে। ওইদিন দলটির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন দলীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এনবিআরের বক্তব্যে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন থেকে সরাতেই তারা সম্পূর্ণ বিভ্রান্তিমূলক কথা বলছে। তিনি বলেন, ‘প্রতিষ্ঠান যখন ভ্যাট দেবে, তখন তারা অন্য জায়গা থেকে অর্থ আনবে না। প্রতিষ্ঠান এই সাড়ে ৭ ভাগ ভ্যাট আদায় করার জন্য প্রকারান্তরে শিক্ষার্থীদের বেতনটা বাড়িয়ে দেবে। সেমিস্টার, ল্যাবরেটরি ফি’সহ অন্যান্য ফিও বাড়িয়ে দেবে। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভ্যাট থাকতে পারে না, কারণ এটা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নয়।

আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ রাজধানীতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরিষদের এক অনুষ্ঠানে অবশ্য বলেন, ভ্যাট ছাত্রদের দিতে হবে না, বিশ্ববিদ্যালয়ই দেবে। তিনি ছাত্রদের ভ্যাটের পরিবর্তে অতিরিক্ত ফি-বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।

ছাত্রদল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি’র ওপর সরকারের সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট আরোপ নিয়ে সৃষ্ট সংকট দ্রুত নিরসনের আহ্বান জানিয়েছে। শুক্রবার সংগঠনের দফতর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারীর পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন ও সাধারণ সম্পাদক মো. আকরামুল হাসান এ আহ্বান জানান।

এর আগে আন্দোলনকারীরা শুক্রবার তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে আলাদা সংবাদ সম্মেলন করেছে। এসব সংবাদ সম্মেলন থেকে টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়া হয়। একটি পক্ষ রোববার থেকে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডেকেছে। অপর অংশ শনিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত ধর্মঘট আহ্বান করে। শিক্ষার্থীদের তৃতীয় অংশটি রোববার ধর্মঘট পালনের ডাক দিয়েছে। এছাড়া এ ইস্যুতে আগামীকাল বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ছাত্র ফেডারেশনেরও ধর্মঘট রয়েছে। ধর্মঘট আহ্বানকারীদের অংশটি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে সংবাদ সম্মেলন করে। এঅংশটি সংবাদ সম্মেলন থেকে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। একই সঙ্গে তারা অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্যেরও প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

সংবাদ সম্মেলনে তারা দাবি জানায়, শুধু শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে নয়, শিক্ষা খাত থেকেই ভ্যাট প্রত্যাহার করতে হবে। এজন্য তারা রোববার থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে লাগাতার ধর্মঘট পালনের ঘোষণা দিয়ে বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে। জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে আমরা রাস্তায় নামব না। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বসে থাকব। সেখানে বসে থেকে ধর্মঘট পালন করব।-যুগান্তর
১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে