সোমবার, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:২৩:০৬

সরকারকে ধন্যবাদ, তবে এর দায় নেবে কে?

সরকারকে ধন্যবাদ, তবে এর দায়  নেবে কে?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : আমাদের দেশিও একটা প্রবাদ আছে ‘গাদা পানি খায় তো খায়, তবে একটু গোলা করে খায়’ । এখন আমাদের দেশের সরকারেরও এমন অবস্থা, শিক্ষায় ভ্যাট প্রত্যাহার ঠিকই করলো তবে দেশের আপামর জনসাধারণের পুরো ঘৃণাটুকু নিয়েই করলো। কেননা, প্রথম থেকেই এই ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবি ছিল সবার। কিন্তু সরকার কারো কথায় কর্ণপাত করলো না। অবশেষে গেল কয়েকদিনে শিক্ষার্থীদের লাগাতর আন্দোলনের পর সরকারের বোধোদয় হয়েছে। আজ সোমবার মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফি’র ওপর আরোপিত সাড়ে সাত ভাগ হারে ভ্যাট প্রত্যাহার করলো সরকার।প্রত্যাহারের ঘোষণার পরপরই রাজধানীর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। শিক্ষার্থীরা রাজপথ ছেড়ে ক্যাম্পাসে ফিরেছে।   

কিন্তু আমাদের কথা হলো-এই সিদ্ধান্ত এত দেরিতে নেয়া হলো কেন? তাহলে সরকার কি দেশের জনগণের ভাষা বুঝতে অক্ষম, না তাদের অন্য কিছু উদ্দেশ্য ছিল। তাই মনে পড়ে গেলো গ্রাম বাংলায় বহুল প্রচলিত আরো দু’টি প্রবাদের কথা-‘ঠেলার নাম বাবাজী’ কিংবা ‘ঠেলায় পড়লে বাঘেও ধান খায়’ । সরকার ঠিকই শিক্ষার্থীদের দাবি মেনে নিল, কিন্তু তাদের এই খামখেয়ালিপনার কারণে এরই মধ্যে জাতির অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।

কেননা, আরোপিত ভ্যাট প্রত্যাহারের দাবিতে গেল কয়েক দিন ধরে আন্দােলন করে আসছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাজপথে শিক্ষার্থীদের লাগাতর অবস্থানে রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলো ছিল অচল। এতে সাধারণ মানুষের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। সেই সাথে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে দেশের অর্থনীতি।

আমরা সবাই জানি, একদিনের হরতালে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, এক্ষেত্রে গেল ৪-৫ দিনে দেশের কত টাকা ক্ষতি হয়েছে তা কি আমাদের অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী একটু হিসেব কষে দেখবেন? মোটা দাগে বলতে গেলে জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে বছরে সম্ভাব্য প্রাপ্য মাত্র ৫৬ কোটি টাকার জন্য দেশের অর্থনীতি কয়েক হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেল। এর দায় কে নিবে?

এ কথা জোর দিয়েই বলতে পারি, অর্থমন্ত্রী ও সরকারের কিছু মন্ত্রী-এমপি ছাড়া দলমত নির্বিশেষে প্রায় সবাই প্রথম থেকেই শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনকে সমর্থন দিয়ে আসছেন। এই ইস্যুতে গোটা জাতি একজোট। তারা যে কোনো মূল্যে এই ভ্যাট প্রত্যাহার চেয়ে আসছে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো- গোটা দেশবাসীর বিরুদ্ধে কেন এই অবস্থান নিলেন অর্থমন্ত্রী? গোটা জাতি যেখানে এটা চাচ্ছেন না সেখানে তিনি কেন জোর করে শিক্ষার্থীদের ওপর ভ্যাট চাপাতে চাইলেন? এতে কার স্বার্থ রক্ষা করতে চাইলেন তিনি?

বিষয়টা প্রকাশ্য না হলেও কিন্তু এর একটা অন্তর্নিহিত কারণ রয়েছ। সেটা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না। বিষয়টা পরিষ্কার-বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা খাতকে একটি উচ্চ মুনাফা তৈরির বাজার হিসেবে ভাবা হচ্ছে। এ জন্য এ খাতের বেসরকারিকরণের জন্য বিশ্বব্যাংক উদগ্রীব। যেমনটি বিশ্বব্যাংক ছিল এ দেশের সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণের ব্যাপারে। সব থেকে বড় উদাহরণ আমাদের আজেকর ভগ্ন-রুগ্ন শিল্পকারখানাসমূহ।   

বিশ্বব্যাংকের এখন দৃষ্টি পড়েছে শিক্ষাখাতের দিকে। দেশের গোটা উচ্চ শিক্ষাখাতকে পণ্য হিসেবে ভাবা হচ্ছে। অর্থ্যাৎ এখানে বিশাল একটি বাজার আছে। এই বাজার দখল করতেই হবে বিশ্বব্যাংককে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা যাতে বেসরকারিকরণ করা হয় ইতোমধ্যো তার একটা বিস্তারিত প্রস্তাবনাও দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বিশ্বব্যাংকের এই কৌশলপত্র অনুযায়ী ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও পরিণত করার একটা প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।

কৌশলপত্রের নির্মাতারা গণরোষের মুখোমুখি হতে পারেন এমন ধারণা থেকেই  একসঙ্গে সব ভর্তুকি উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব নয় বলে কৌশলপত্রে মন্তব্য করেছেন। এক সঙ্গে কৌশলপত্র বাস্তবায়ন হলে তীব্র ছাত্র আন্দোলনের মুখে পড়ার ভয় থেকে ধাপে ধাপে বেসরকারিকরণের পথ বেছে নিয়েছে ইউজিসি ও বিশ্বব্যাংক।

চার পর্বের প্রথম ধাপগুলো হলো প্রাথমিক পর্ব ২০০৬-২০০৭, স্বল্পমেয়াদি ২০০৮-২০১৩, মধ্যমেয়াদি ২০১৪-২০১৯ এবং দীর্ঘমেয়াদি ২০২০-২০২৬। কৌশলপত্রের সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হলে একজন শিক্ষার্থীর শিক্ষার পুরোটাই অধিক দামে ক্রয় করতে হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।

সময়ের হিসেবে এখন এই কৌশলপত্র মধ্যবর্তী অবস্থা পার করছে। এ কারণে ইতোমধ্যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টারের নামে শিক্ষা ব্যয় বেড়েছে। সাম্প্রতিককালে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নিয়ে ছাত্র বিক্ষোভও হয়েছে। ফলে সে উদ্যোগ অনেকটাই থামানো গেছে। কিন্তু নিরবে নানান অজুহাতে শিক্ষা ব্যয় বাড়ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিনিয়ত।

এর প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, সাম্প্রতিককালে দেশে যে সব পাবলিক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে পুরাতনগুলোর তুলনায় বেতনসহ অন্যান্য শিক্ষা ব্যয় কয়েক গুণ বেশি। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজস্ব খাত থেকে আয় বাড়ানো এবং ব্যয় নির্বাহের কথা বলা হয়েছে। এর ফলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ব্যয় ক্রমেই বাড়ানো হয়েছে।এ নিয়ে কবি নজরুল, কুমিল্লা, পটুয়াখালি ও পাবনাসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিকবার ব্যাপক ছাত্রবিক্ষোভও হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বেতনসহ অন্যান্য খরচ বৃদ্ধি করা থেকে পিছ পা হননি। ফলে বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে আমাদের উচ্চশিক্ষাকে যে বাণিজ্যকীকরণের প্রক্রিয়া চলছে সেটা অর্থমন্ত্রীর ভুমিকা থেকে সহজেই বোধগম্য। আর সেটা হয়ে গেলে আমাদেরকে যে অন্যান্য পণ্যের মত শিক্ষাকেও উচ্চমূল্যে কিনতে হবে। আর উচ্চশিক্ষা ক্রমেই নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাবে। তাই এই আন্দোলন সফল হওয়াটা খুবই জরুরী ছিল। ফলে এই বিজয় শুধু আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নয়, এই বিজয় শিক্ষাব্যবস্থার বিজয়, এই বিজয় গোটা জাতির বিজয়।        

এ কথা আমাদের সবার জানা, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগান নিয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের বাঙালী জাতি ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানীদের শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধে অনেক রক্ত আর ত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করে জনগণ। আজ দেশ স্বাধীনের ৪৪ বছর পরও একই শোষণ-নিপীড়ন। যে গণতন্ত্রের জন্যে এতো আত্মত্যাগ, আজ সেই গণতান্ত্রিক চর্চা ও মূল্যবোধ কোথায়?

দেশের মানুষের অধিকার এবং স্বাধীনতা ক্রমেই সংকীর্ণ হচ্ছে। শিক্ষার মতো একটি অধিকারকেও রাষ্ট্র এখনো মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। বরং পুরো উল্টোপথে হাঁটছে সরকার। এগুলো দেশের জন্য শুভকর নয়।

ক্ষমতা বলে জোর করে কোনো কিছু জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়া যেমন গণতান্ত্রিক রীতি নয়, তেমনি জনমতকে উপেক্ষা করা্ও কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ হতে পারে না। ‘গণতন্ত্র’ মানে নিছক নির্বাচন নয়, রাষ্ট্রগঠনের-প্রক্রিয়া ও ভিত্তি নির্মাণের গোড়া থেকেই জনগণের ইচ্ছা ও অভিপ্রায় নিশ্চিত করা। জনগণের সেই ইচ্ছা ও অভিপ্রায় রাষ্ট্র পরিচালনার সর্বক্ষেত্রে নিশ্চিত করা না গেলে তাকে কোনোভাবেই ‘গণতন্ত্র’ বলা যায় না।

নিজের অধিকারের উপলব্ধির মধ্যে দিয়েই অপরের অধিকার এবং নিজেদের সমষ্টিগত অধিকার ও দায়-দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন হওয়া ও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। ব্যক্তির যে-মর্যাদা অলঙ্ঘনীয়, প্রাণ, পরিবেশ ও জীবিকার যে-নিশ্চয়তা বিধান করা ছাড়া রাষ্ট্র নিজের ন্যায্যতা লাভ করতে পারে না এবং যে সব নাগরিক অধিকার সংসদের কোনো আইন, বিচারবিভাগীয় রায় বা নির্বাহী আদেশে রহিত করা যায় না- সেই সব অলঙ্ঘনীয় অধিকার অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগঠনের ভিত্তি।

মানুষ ও নাগরিক হিসেবে এই সব অধিকার ঐতিহাসিক লড়াই-সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মানবেতিহাস অর্জন করেছে এবং সেই সব অধিকারের সার্বজনীনতা নানান আন্তর্জাতিক ঘোষণা, সনদ ও চুক্তির মধ্যে দিয়ে আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই স্বীকৃত অধিকারগুলো কী বাংলাদেশের নাগরিকরা ভোগ করতে পারছেন?

ফলে বলা যায়- স্বীকৃত অধিকারগুলো নাগরিকরা যতদিন স্বাধীনভাবে ভোগ করতে না পারবে ততদিন তাদের সংগ্রাম চলবেই। আর সংগ্রামের মধ্যদিয়েই তাদের অধিকার একসময় প্রতিষ্ঠিত হবে।

ফলে আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট আরোপ বেনিয়াদের একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনারই অংশ বিশেষ। শিল্প কারখানার মতোই আমাদের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্র ধ্বংসের একটি প্রক্রিয়া, নিম্ন-মধ্যবিত্তের শিক্ষাগ্রহণের পথে বড় অন্তরায় সৃষ্টির গভীর ষড়যন্ত্র। এই ভ্যাট আরোপ শুধু অনৈতিকই নয়, গোটা জাতির বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রও বটে। ফলে আগামী দিনেও এ ধরনের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে সােচ্চার হতে হবে। যে কোনো মূল্যে রুখতে হবে বেনিয়াদের সব অপতৎপরতা।  

আজ পাবিলক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো ও মান মর্যাদার বিষয়েও সরকার যে একগেয়েমী ভুমিকা নিয়েছে আশা করবো অচিরেই তা থেকে  সরে এসে শিক্ষকদের চারদফা দাবি মেনে নিয়ে শিক্ষাঙ্গনে অচলবাস্থার অবসান ঘটাবে। এ ক্ষেত্রে আশা করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ বিষয়েও আন্তরিক হবেন। সেই সাথে এই ক'দিন বিনা কারণে আপামর জনসাধারণকে কষ্ট দেওয়ায় দেশবাসীর কাছে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রতি আহবান জানাচ্ছি। সবশেষে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিনন্দন জানাচ্ছি, কেননা, তাদের এই আন্দোলন আগামী দিনের শিক্ষার্থীদের জন্য পাথেয় হয়ে থাকবে।
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে