মঙ্গলবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:৩০:২২

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন-কিসিঞ্জার

 মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যা বলেছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন-কিসিঞ্জার

দীপেন্দু পাল : প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কথা।  পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের বীর সেনাবাহিনী একাত্তরের সেই বিখ্যাত জয় ছিনিয়ে এনেছিল। সঙ্গে ছিল মস্কোর স্ট্র্যাটেজিক সাপোর্ট।  অনেকেই হয়তো জানেন না, সেবার ক্রেমলিনের ‘ট্রাম্প কার্ড’ খেলেই মার্কিন চাপ ও তাদের ব্রিটিশ ফেউকে রুখে দিয়েছিল দিল্লি।

৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত জয় পায় ভারত।  যদিও পাকিস্তানই ভারতের ছয়-ছ’টি বিমানঘাঁটি লক্ষ্য করে প্রথম হামলা চালায়।  ভারতকে কার্যত বাধ্য হয়ে প্রতিরোধের জন্য যুদ্ধের পথ বেছে নিতে হয়।

সেই সময় আমেরিকা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে৷ এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সঙ্গে তার পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের কী কথা হয়েছিল, সম্প্রতি তা প্রকাশ্যে এসেছে।  কথোপকথনটি তুলে ধরা হলো :

৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১, সকাল ১০টা ৪৫ মিনিট :

নিক্সন: …তার মানে পশ্চিম পাকিস্তান (বাংলাদেশের ঘোষিত সরকার তখনও মার্কিন প্রশাসনের স্বীকৃতি পায়নি, তাদের চোখে তখনও তা পূর্ব পাকিস্তান) এখন সমস্যায় পড়েছে।

কিসিঞ্জার : এখন পাক বাহিনীর যা দশা, এই যুদ্ধে হেরে গেলে ওদের অর্ধেক বাসিন্দাই মারা পড়বে।

নিক্সন : পাকিস্তানের ঘটনা হৃদয় বিদারক…(এ কথা বলার সময় ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নামে গুটিকয়েক অশ্রাব্য ভাষা প্রয়োগ করেছিলেন নিক্সন)৷

পরবর্তী কথোপকথন৷ ওয়াশিংটন, ১০ ডিসেম্বর, ১৯৭১, বেলা ১০টা ৫১ মিনিট

(যুদ্ধে কখনই সুবিধা করে উঠতে পারেনি পাকিস্তান।  পাক বিমানবাহিনীকে তখন সমূলে বিনষ্ট করছে ভারতীয় বিমানবাহিনী৷ তার ওপর পূর্ব ও পশ্চিম উভয় সেক্টরেই অবিরাম মার খেয়ে পাক সেনাবাহিনীও হতমান।)

নিক্সন : পশ্চিম পাকিস্তানকে যে করেই হোক বাঁচাতে হবে।

কিসিঞ্জার : একদম ঠিক বলেছেন মি. প্রেসিডেন্ট।

নিক্সন : ঠিক আছে।  নেভিকে বলুন, রণতরী এগিয়ে নিয়ে যেতে।  এখনই!

কিসিঞ্জার : ওকে, মিস্টার প্রেসিডেন্ট।  রণতরী প্রস্তুত।  পাশাপাশি জর্ডন থেকে চারটি যুদ্ধবিমানও পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে।  আরও ২২টি যাচ্ছে সেখানে। আমরা সৌদিদের (সৌদি আরব) সঙ্গেও কথা বলে রেখেছি।  তুরস্কও পাঁচটি জঙ্গিবিমান পাঠাতে রাজি।  আমরা পুরোপুরি তৈরি।  ভারত যদি সমঝোতায় রাজি না হয় তাহলে…

নিক্সন : এক কাজ করুন, চীনকে বলুন, ওরাও আমাদের সাহায্য করছে এ রকম একটা হুমকি ভারতকে দিয়ে রাখুক।

কিসিঞ্জার : এক্কেবারে ঠিক বলেছেন, মি. প্রেসিডেন্ট।

নিক্সন : ফ্রান্সকেও বলুন কিছু একটা করতে।  বিমান ওড়াক বা অন্তত একটা ডিভিশন সরবরাহ করুক ভারতের বিরুদ্ধে।  আপনি বুঝতে পারছেন তো আমি কী বলতে চাইছি?

কিসিঞ্জার : ইয়েস, মি. প্রেসিডেন্ট।

নিক্সন : ভারতীয়রা ভীতু, সেটা জানেন তো?

কিসিঙ্গার : আপনি ঠিক বলেছেন মি. প্রেসিডেন্ট।  কিন্তু ব্যাপারটা হলো, রাশিয়ার সাহায্য।  আপনি তো জানেন রাশিয়া এরই মধ্যে ইরান ও তুরস্কে পত্র পাঠিয়েছে।  এই খেলায় রাশিয়া ওস্তাদ।

ডিসেম্বরের ১০ তারিখে সোভিয়েত ইউনিয়ন মারফত নিক্সন ও কিসিঙ্গারের কথোপকথনটির প্রথম হদিস পান ভারতের গোয়েন্দারা।  মার্কিন নৌবহর সেভেন্থ ফ্লিট তখন ওয়ার জোনে ঢোকার অপেক্ষায়।  তারা অপেক্ষা করছে টংকিন উপসাগরে।  মার্কিন নৌবহরের ভাঁড়ারে সেই সময় ৭৫ হাজার টন নিউক্লিয়ার বোমাও রয়েছে।

মার্কিন নৌবহরকে ঠেকাতে তখন একমাত্র ভরসা ভারতীয় নৌবাহিনীর ২০ হাজার টনের বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ আইএনএস বিক্রান্ত।  জাহাজের কমান্ডিং ইন চিফ ছিলেন ভাইস অ্যাডমিরাল এন কৃষ্ণন।  তার কাছে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর এক কর্তা জানতে চান, ২০টি লাইটওয়েট ফাইটার এয়ারক্রাফ্ট নিয়ে মার্কিন নৌবহরের মুখোমুখি হতে পারবেন?

এন কৃষ্ণন জবাব দেন, একবার নির্দেশ দিয়ে দেখুন।  এই কথার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বিদেশি সহায়তায় বলীয়ান পাকিস্তানি বিমানবাহিনীকে কার্যত সাফ করে দিয়েছিল ভারতীয় বায়ুসেনা।

এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দারা জানতে পারেন, ব্রিটিশ এক নৌবহরও আমেরিকান সেভেন্থ ফ্লিটের সহযোগী হিসেবে ভারতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ ব্রিটিশ ওই নৌবহরকে নেতৃত্ব দিচ্ছে কেরিয়ার ইগল নামের এক রণতরী৷

যারা ভারতীয় জলসীমার একেবারে ধার ঘেঁসে দাঁড়িয়ে রয়েছে।  অর্থাৎ বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, বিশ্বের বড় দুই গণতন্ত্রী রাষ্ট্র পৃথিবীর সব থেকে বড় গণতন্ত্রকে যেকোনো মুহূর্তে নিকেশ করতে উদ্যত।

এতকিছুর মধ্যেও কিন্তু ভারত এতটুকু বিচলিত হয়নি।  বরং চুপচাপ ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে মস্কোকে বার্তা পাঠানো হয়, ভারত-সোভিয়েত সামরিক চুক্তি মোতাবেক দিল্লি নিশ্চিত ভারতীয় জলসীমানায় অনুপ্রবেশকারীদের নিরস্ত করবে রাশিয়া।

ভারতকে নতজানু করতে আমেরিকা ও ব্রিটেনের নৌবহর তখন আগুয়ান। ব্রিটিশ রণতরী ঢুকছে আরব সাগরের দিক থেকে আর মার্কিন নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিক থেকে।  মার্কিন সেভেন্থ ফ্লিট লক্ষ্য আবার অধুনা বাংলাদেশ।  কারণ সেখানেই তখন ১০ হাজার পাক সেনা ভারতের সেনাবাহিনীর মারের চোটে চোখে সরষেফুল দেখছে।

আর ঠিক তখনই ইন্দিরা গান্ধীর বার্তায় সাড়া দিয়ে মোক্ষম দান চালল রাশিয়া।  ব্রিটেন ও আমেরিকাকে ঠেকাতে সোভিয়েত রাশিয়া তাদের নিউক্লিয়ার শক্তিসম্পন্ন নৌবহর পাঠাল ভারত মহাসাগরে, ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে।

কমান্ডিং অফিসার ছিলেন অ্যাডমিরাল ভ্লাদিমির ক্রুগলিয়াকভ।  অবসর নেয়ার পর নিজের মুখেই সে কথা স্বীকার করেছেন তিনি।  তার বক্তব্য, আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল মার্কিন নৌবহরের সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর।  নির্দেশ ছিল, ভারতের ওপর যেন কোনও মতেই হামলা না চালাতে পারে মার্কিন ও তাদের ব্রিটিশ তল্পিবাহকেরা।

সেই সময় রুশ গোয়েন্দারা মার্কিন সেনাবাহিনীর একটি কথোপকথন ইন্টারসেপ্ট করে শুনতে পান, কোনও সেনা অফিসার তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছেন, স্যার, আমরা দেরি করে ফেলেছি।  পরমাণু বোমা সমেত বিশাল রুশ নৌবহর (টোয়েন্টিয়েথ ফ্লিট) উপস্থিত হয়েছে।

চারদিক তখন থম থম করছে৷ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটা কি তাহলে শুরু হবে ভারতের জলসীমাতেই? প্রতিপক্ষ দুই কমান্ডার তখন দূরবীণে একে অপরের নৌবহরকে দেখতে পাচ্ছেন৷ শেষ পর্যন্ত সেই স্নায়ুযুদ্ধে জয় হয় মস্কোরই৷ ভারতের জলসীমা থেকে লেজ গুটিয়ে পিছটান দেয় মার্কিন ও ব্রিটিশ নৌবহর।

ওদিকে তখন লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সামনে পাক জেনারেল নিয়াজির হাঁটু গেড়ে বসা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা৷ আর পশ্চিম সেক্টরে কী স্থলে কী আকাশপথে ত্রিবর্ণের ছটায় ত্রিভুবন অন্ধকার পিন্ডির (অর্থাৎ পাক সামরিক সদর দফতর রাওয়ালপিন্ডির)৷

সম্প্রতি ভারতীয় বিদেশমন্ত্রীর একটি ছয় পাতার রিপোর্ট প্রকাশ্যে এসেছে। সেই রিপোর্ট থেকেই উপরোক্ত তথ্যগুলো মিলেছে।  নিক্সন-কিসিঙ্গার ট্রান্সক্রিপটটি প্রকাশ করেছে ডিফেন্স নিউজ৷

উল্লেখ্য, রিচার্ড নিক্সন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি থেকে ১৯৭৪ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত।  তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা (পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী) ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।
 সূত্র : কলকাতা২৪
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে