বুধবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:৩৯:০২

গণতান্ত্রিক দেশ যুদ্ধ জয় নয়, উদযাপন করে মুক্তিসনদ

গণতান্ত্রিক দেশ যুদ্ধ জয় নয়, উদযাপন করে মুক্তিসনদ

কুলদীপ নায়ার : গণতান্ত্রিক দেশ মুক্তিসনদ (ম্যাগনা কার্টা) উদ্যাপন করে, যুদ্ধে বিজয় নয়। যুদ্ধজয়ের দিনটি উদ্যাপন করা হলে বোনাপার্টিজম (সেনা অভিযান চালিয়ে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যেভাবে পররাজ্য দখল করতেন, সেভাবে ভিনদেশকে কব্জা করার রীতি) উৎসাহিত হয়। তাতে তো কোনোক্রমেই জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না। সংবাদপত্রে পূর্ণ পৃষ্ঠার একটি বিজ্ঞাপন দেখে হতাশ হলাম। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অর্জিত বিজয় স্মরণে ওই বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপনে বলা হয়, 'যুদ্ধ শুরু হয় ১৯৬৫'র ৫ আগস্ট, আর শেষ হয় ২৩ সেপ্টেম্বর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এ যুদ্ধেই প্রচণ্ড ট্যাংকযুদ্ধ হয়েছিল। ১৯৬৫'র আগস্টের গোড়ার দিকে পাকিস্তান কাশ্মীরে সৈন্য পাঠিয়েছিল। এ অভিযানের নাম দিয়েছিল 'অপারেশন জিব্রাল্টার'।

তাদের অগ্রাভিযান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য ২৮ আগস্ট ভারতীয় সেনারা কৌশলগত গুরুত্বপর্ণ হাজী পীর গিরিপথ দখল করে নেয়। পাকিস্তান তখন আখনুর সেক্টরে 'গ্র্যান্ড স্ল্যাম অপারেশন' শুরু করে। তাদের রুখে দিতে ভারত পশ্চিম রণাঙ্গনের সূচনা করল। আসাল উত্তরের যুদ্ধে পাকিস্তানের আর্মরড ডিভিশন ওয়ান বিপর্যস্ত হয়ে গেল, তাদের প্রায় ১০০ ট্যাংক ধ্বংস করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া বড় ধরনের আরও কিছু লড়াই হয়েছিল পুন্চ্, ফিলোরা, বারকি ও দোগরাই এলাকায়।

এটা সত্য যে, ওই যুদ্ধে সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল ভারত। তবে সেটাকে ৪৫ শতাংশের বিপরীতে ৫৫ শতাংশ বলতে হবে। মাপকাঠি হলো লাহোর। আমরা শহরটা দখল করতে পারিনি, জায়গাটার পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের। ওই সময়টায় ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল জে এন চৌধুরী। তিনি যুদ্ধোত্তর এক সাক্ষাৎকারে আমায় বলেছেন, লাহোর দখল করাটা কখনই তার পরিকল্পনায় ছিল না। ওটা করতে গেলে বিপুলসংখ্যক সৈন্যকে এক জায়গায় অনর্থক লাগিয়ে রাখতে হতো এবং আমাদের পক্ষে হতাহতও হতো বিস্তর।

জেনারেল চৌধুরীর মতে, শহরটির প্রতিরক্ষায় পাকিস্তান সর্বশক্তি ঢেলে দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে বাড়ি-বাড়ি, রাস্তায়-রাস্তায় লড়ত। ব্যাখ্যাটা বেশ যৌক্তিক বটে। তবে সাধারণ্যে ধারণা করা হয়, লাহোর পদানত করতে ভারত ব্যর্থ হয়েছে। লাহোরকে পাশ কাটিয়ে ছোট্ট যে সেনা দলটি রাভি সেতু অবধি পৌঁছেছিল তাদের চুরমার করে দেওয়া হয়েছিল। জেনারেল জে এন চৌধুরী বলেছিলেন যে, সৈন্যদের রাভি সেতু পর্যন্ত এগিয়ে যাওয়ার অনুমোদন ছিল না। ওই ধরনের বিষয় ছিল না তার রণপরিকল্পনায়ও। তার কথা সত্যই। কিন্তু সরলসিধা লোকজনের চিন্তা-ভাবনা আলাদা। তারা মনে করে লাহোর দখল করবার শক্তি-সামর্থ্য ভারতের নেই।

জেনারেল চৌধুরী জানান, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের সাঁজোয়া ধ্বংস করা। বিশেষত প্যাটন ট্যাংক ধ্বংস করা। এসব ট্যাংক পাকিস্তানকে দিয়েছিল আমেরিকা। ওই এলাকার ইচ্ছোগিল খালকে কাজে লাগায় ভারতীয় বাহিনী। তারা খালটির এমন দশা করল যে খালের পানি ছড়িয়ে পড়ল ডাঙায়। ওই পানিতে ট্যাংকগুলো আটকে থাকল। যে প্রশ্নটার জবাব মিলছে না, তা হলো : ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের জন্য কে দায়ী? ওই সময়টায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেনারেল মোহাম্মদ আইউব খান; একই সঙ্গে তিনি সামরিক আইন প্রশাসক ও কমান্ডার-ইন-চিফ। আইউই খান আমায় বলেছেন, ওটা তো ছিল 'ভুট্টোর যুদ্ধ'। তাকে (প্রেসিডেন্টকে) না জানিয়ে, ভুট্টো (তখন ছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী) কাশ্মীরে অনুপ্রবেশকারীদের পাঠিয়েছিলেন। জেনারেল আইউবের ছেলে গওহর আইউব তার বাবার দেওয়া তথ্য সমর্থন করেন।

শুধু তাই নয়, ওসব তথ্য সম্বন্ধে প্রকাশ্যেও নিজ অভিমত তুলে ধরেন। ইসলামাবাদের উপকণ্ঠে প্রাসাদোপম একটা বাড়িতে বাস করেন গওহর। 'মুসলিম' পত্রিকার তদানীন্তন সম্পাদক মুশাহিদ হোসেন ব্যবস্থা করেছিলেন সাক্ষাৎকারের। গওহর আমায় মধ্যাহ্নভোজের দাওয়াত করলেন। দিনটা আমার পরিষ্কার মনে পড়ে। গওহরের বাড়িতে বসেই আমি শুনতে পাই যে, ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত। ইন্দিরা প্রসঙ্গে গওহর অত্যন্ত কম কথা বললেন এবং তাও বিলকুল হেলাফেলায়। গওহর আইউব আসলে আমায় এমন কথা বলতেই আগ্রহী ছিলেন যা আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর জন্য খুবই অস্বস্তিকর।

তিনি জানান, আমাদের সাঁজোয়া ব্যবস্থাপনায় একটা ফাটল ছিল। আমি নিশ্চিত তা ছিল। কিন্তু আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম যখন গওহর বললেন, 'ভারতের সামরিক সদর দফতর থেকে অতিগোপনীয় কাগজপত্র নেহেরুর টেবিলে পৌঁছার আগে তার অনুলিপি আমাদের হাতে এসে যেত।' সেকালে নয়া দিলি্লর সাউথ ব্লক (সচিবালয়)-এর বারান্দার এ মাথা-সে মাথায় হাঁটাহাঁটি করা যেত। নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল শিথিল। গেট পার হলেই আবার গেট, যা এখন দেখা যায়, ছিল না। একজন বাহক কয়েক গজ হেঁটে গিয়ে নেহেরুর অফিসে কাগজপত্র পৌঁছানোর আগে তা কীভাবে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দাদের হাতে চলে যায়? গওহর আইউব তার সঙ্গে আলাপকালে দৃষ্টান্তস্বরূপ সেই ভারতীয় ব্রিগেডিয়ারের কথা বলেননি যিনি ২০ হাজার রুপির বিনিময়ে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ পরিকল্পনা দিয়ে দিয়েছিলেন।

গওহর বলেছিলেন যে, তার পিতা খুবই নিন্দামন্দ করতেন যে 'ভারতীয় অফিসাররা মাত্র কয়েক হাজার টাকার জন্য তাদের দেশ বিক্রি করে দিচ্ছে।' বিষয়টি নিয়ে আমি গওহরের সঙ্গে আলোচনা করলাম না। কারণ এ ধরনের কথা আমি প্রথমবারের মতো শুনলাম। গওহরকে আমি অবশ্য সেসব কথা ঠিকই বললাম যেগুলো তার পিতা ১৯৭২ সালে ইসলামাবাদে কাশ্মীরিদের সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন। সে বছর আমি ইসলামাবাদ যাই জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য। ঢাকায় বিপর্যস্ত হওয়ার পর ভুট্টো তখন স্বল্পকালের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আইউব খান বলেন, ভুট্টো তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে কাশ্মীরিরা যেই জানবে যে তাদের মধ্যে পাকিস্তানি সৈন্যরা এসে পড়েছে অমনই তারা বিদ্রোহ করবে।

অনুপ্রবেশকারীদের 'ভুট্টোর মুজাহিদ' বলে উল্লেখ করলেন আইউব। আইউব জানান, তিনি ভুট্টোকে বলেছেন, 'দেখ, কাশ্মীরিদের সম্বন্ধে আমি যতদূর জানি, ওরা কখনই বন্দুক উঁচিয়ে ধরবে না।' কাশ্মীরসংক্রান্ত রিপোর্টগুলো বানিয়ে বানিয়ে তার পিতার কাছে পেশ করা হতো বলে মনে করেন গওহর। এটা তার ভুল ধারণা। তার পিতা নিজেই আমায় বলেছেন যে, অনুপ্রবেশের মাত্রা সম্বন্ধে ভুট্টো তাকে কিছুই কখনো জানাননি (পরিহাস এই যে, জেদ্দায় নির্বাসনে থাকবার সময় নওয়াজ শরিফ আমাকে ঠিক এভাবেই জানিয়েছিলেন যে, কারগিলে পাকিস্তানের অপ-অভিযানের বিষয়ে তাকে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল)।

১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের আক্রমণ শুরু হয়, চুপিসারে শত শত সৈন্যের- যাদের ভুট্টো বলতেন 'মুজাহিদ' কাশ্মীরে ঢুকে পড়ার পরই। অনুপ্রবেশের সংবাদ ভারতীয় পত্রপত্রিকায় প্রথম আসে ১৯৬৫'র ৯ আগস্ট। একই সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডিতে ভারতের নতুন হাইকমিশনার কেওয়াল সিংয়ের পরিচয়পত্র গ্রহণের সময় প্রেসিডেন্ট আইউবের বক্তব্যও প্রকাশিত হয়। কেওয়াল সিংকে আইউব খান বলেন, সহযোগিতা উন্নয়নের জন্য ভারতের নেওয়া প্রতিটি উদ্যোগে পাকিস্তান ইতিবাচক সাড়া দেবে। তিনি যুক্তি দেখান যে, কাশ্মীরে অনুপ্রবেশ আর ভারতে অনুপ্রবেশ এক কথা নয়।

যে 'অভ্যুত্থান' ঘটবে বলে পাকিস্তান আশা করেছিল তা না ঘটবার কারণ কাশ্মীরিরা অনুপ্রবেশকারীদের সাহায্য করেনি। আমি যখন ভুট্টোর সাক্ষাৎকার নিলাম তখন তিনি আইউবের অভিযোগ- ১৯৬৫'র যুদ্ধ ভুট্টোর অপকীর্তি- অস্বীকার করেননি। ভুট্টো বলেন, 'শিক্ষা হয়েছে। আর আমি ওই কাজ করব না।' ১৯৬৫'র যুদ্ধজয়, যত সীমিতই হোক, সম্বন্ধে নয়া দিলি্ল যদি আদতেই কিছু বলতে চায় তবে তা হিংসা ও অস্ত্রের বড়াই নয়, বেশি করে বলা উচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হওয়ার কারণে ভারত যে কল্যাণকর ভূমিকায় আছে সে সম্পর্কে। ভারতের একটা সুবিধা এই যে তার সার্বভৌমত্ব জনগণের সঙ্গে। পাকিস্তানে সবার আগে সশস্ত্রবাহিনীর স্বার্থ। নয়া দিলি্ল গণতন্ত্র রপ্তানি করতে পারবে না। কিন্তু সেই শাসনে ফিরে যেতে তো সহায়তা করতে পারে যে ব্যবস্থায় জনগণের রায়ই শেষ কথা।-বিডিপ্রতিদিন
১৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে