বৃহস্পতিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০২:৪৯:৩১

দল গোছাতে গিয়ে উল্টো এলোমেলো বিএনপি

দল গোছাতে গিয়ে উল্টো এলোমেলো বিএনপি

এনাম আবেদীন : পুনর্গঠনের বিষয়ে কেন্দ্রের নির্দেশনায় তৃণমূল বিএনপিতে চাঙ্গাভাব সৃষ্টি হয়েছে। তবে চাঙ্গা পরিস্থিতি সামাল দিতে অর্থাৎ পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া সামলাতে সংশ্লিষ্ট নেতারা হিমশিম খাচ্ছেন। বেশির ভাগ জেলা, উপজেলা ও পৌর শাখায় নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল মাথাচাড়া দিয়েছে। অনেক জায়গায় কমিটি গঠনই আটকে গেছে।

দলাদলি রেষারেষির সূত্রে বেশ কয়েক জায়গায় মেয়াদ শেষ না হওয়ার পরও কমিটি ভেঙে দেয়া হয়। কোথাও কোথাও কোন্দল চরমে পৌঁছায় কেন্দ্র থেকে চিঠি দিয়ে পুনর্গঠন-প্রক্রিয়া থামিয়ে দেয়া হয়েছে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থ জেলা নেতাদের অনেকেই এখন ঢাকায় অবস্থান করছেন। তাঁরা নেতৃত্ব তথা কমিটিতে পদ পাওয়ার বিষয়ে তাঁদের আগ্রহের কথা কেন্দ্রীয় নেতাদের জানাচ্ছেন। তদবির করছেন। আবার প্রতিপক্ষের ব্যাপারে নালিশও করছেন। গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে বা দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের বাসায় বাসায় ধরনা দিচ্ছেন তাঁরা। নিজেদের সমস্যার সমাধান তাঁরা নিজেরা করতে পারছেন না; দ্বারস্থ হয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের।

পুনর্গঠনের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান প্রতিবেদককে বলেন, 'এ সম্পর্কে আমি বিশেষ কিছু জানি না। তবে শুনছি, সারা দেশেই এ নিয়ে দলাদলি ও বিভ্রান্তি আছে।'

গোছাতে গিয়ে উল্টো এলোমেলো বিএনপি

নিজের এলাকা দিনাজপুর জেলার কথা জানাতে গিয়ে মাহবুবুর রহমান বলেন, সেখানে পকেট কমিটি গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে বলে অনেকে অভিযোগ করছে। পুনর্গঠন নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়ায় জেলার অনেক নেতাই এখন ঢাকায়।

যুগ্ম মহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহান বলেন, বিএনপির মতো বড় দলে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা স্বাভাবিক। এসব সামাল দেয়ার মতো অভিজ্ঞতাও দলের আছে। তিনি বলেন, এতে বরং প্রমাণিত হয়, বিএনপির প্রতি দেশের মানুষের এখনো আস্থা আছে। তাই নেতৃত্বে তারা থাকতে চাইছে, আসতে চাইছে।

এক প্রশ্নের জবাবে মোহম্মদ শাহজাহান বলেন, 'নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই পুনর্গঠন প্রক্রিয়া আমরা সম্পন্ন করার পক্ষে। তবে বাস্তব ও যথাযথ কারণ থাকলে কেন্দ্র সময় বাড়াবে।'

বরিশাল বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুজিবুর রহমান সারোয়ার জানান, বরগুনা ছাড়া তাঁর বিভাগের অন্য কোথাও সমস্যা হয়নি। পুনর্গঠন সম্পন্ন করতে কিছু সময় বাড়ানো দরকার বলে মনে করেন তিনি।

নাটোর জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুর মতে, দল পুনর্গঠনের মতো বাস্তবতা এখন দেশে নেই। তিনি বলেন, 'মামলা-হামলা ও পুলিশের ভয়ে সারাক্ষণ দৌড়ের ওপর আছি। পুনর্গঠন কী করে হবে!' তাঁর মতে, সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে যাঁরা 'ফ্রি' আছেন তাঁদের অনেকে এ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছেন।

নরসিংদী জেলা বিএনপির সভাপতি খায়রুল কবীর খোকন জানান, পুলিশের হয়রানির ভয়ে কিছুটা দেরি হলেও নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই পুনর্গঠন সম্পন্ন হবে। আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালকারী নেতাদেরই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

ময়মনসিংহ উত্তর জেলা বিএনপির এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়ক মোতাহার হোসেন তালুকদার অভিযোগ করেন, আহ্বায়ক একক কর্তৃত্বে তাঁর নিজের এলাকা নান্দাইলে বৈঠক ডেকে সংকট তৈরি করেছেন। অথচ নিয়ম অনুযায়ী আহ্বায়ক ও এক নম্বর যুগ্ম আহ্বায়কের যৌথ স্বাক্ষরে বৈঠক ডাকার কথা। এতে অন্য নেতারা আপত্তি তুলে কেন্দ্রকে জানান। কেন্দ্র চিঠি দিয়ে ওই বৈঠক বন্ধ করে দেয়। শেষ পর্যন্ত কমিটি গঠন বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, সংস্কারপন্থীদের চেয়ারপারসন ক্ষমা করে দিয়েছেন। আর এ সুযোগে তাঁরা আবার পকেট কমিটি গঠনের পাঁয়তারা করছেন।

কারা পাঁয়তারা করছেন জানতে চাইলে মোতাহার হোসেন তালুকদার জেলা বিএনপির আহ্বায়ক খুররম খান চৌধুরী ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফুলপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শাহ শহীদ সারোয়ারের নাম জানান।

জানা গেছে, কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহান চিঠি দিয়ে ময়মনসিংহ উত্তর জেলার নেতাদের ঈদের পর ঢাকায় এসে বৈঠক করে সমস্যার সমাধান করতে বলেছেন।

ঝিনাইদহ পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মজিদ বিশ্বাস বলেন, কেন্দ্রের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে সারা দেশে কমিটি পুনর্গঠন সম্ভব নয়। নিজের এলাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সদর উপজেলা শাখার সম্মেলন আগামী ১০ অক্টোবর। পৌর শাখার সম্মেলন ১৫ অক্টোবরের আগে সম্ভব নয়। ওয়ার্ড কমিটি গঠন শেষ করে পৌর কমিটি গঠনে বিলম্ব হবে।

প্রসঙ্গত, গত ৯ আগস্ট কেন্দ্রীয় বিএনপি সারা দেশে চিঠি পাঠায়। তাতে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুনর্গঠনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত ৭৫টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৫০টিতে প্রস্তুতি সভা হয়েছে। এসব সভা থেকে উপজেলা ও পৌর শাখাগুলোকে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ২৫-৩০টি উপজেলায় প্রস্তুতি সভা করে ইউনিয়ন শাখাগুলোকে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে গত প্রায় এক মাসে কোনো জেলার কোনো কমিটি গঠনের তথ্য কেন্দ্রে আসেনি।

বিধান অনুযায়ী, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ভোটে ইউনিয়ন কমিটি, ইউনিয়ন কাউন্সিলরদের ভোটে উপজেলা কমিটি, উপজেলা ও পৌরসভা কাউন্সিলরদের ভোটে জেলা কমিটি গঠিত হবে। জেলা কমিটির অনুমোদন দেবে কেন্দ্র, উপজেলা ও পৌর কমিটিকে অনুমোদন দেবে জেলা এবং ইউনিয়ন কমিটির অনুমোদন দেবে উপজেলা। সব শেষে জেলা ও মহানগর কাউন্সিলরদের ভোটে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তথা কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি গঠিত হবে। তবে এ চর্চা বিএনপিতে দেখা যায় না। জাতীয় কাউন্সিলে ভোটের রেওয়াজ প্রায় বিলুপ্ত। গত দুটি জাতীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলররা চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাতে পূর্ণ ক্ষমতা ন্যস্ত করেন। পরে তাঁর নির্দেশে বা পরামর্শে সব কমিটি ঘোষণা করা হয়।

যে কারণে কোন্দল : ৫ জানুয়ারি কেন্দ্রিক দুটি আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জেলা, উপজেলা ও পৌর বিএনপিতে দ্বন্দ্ব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। আন্দোলনের কারণে দলের নেতাকর্মীদের বড় একটি অংশ হয় কারাগারে, না হয় আত্মগোপনে। তৃণমূলে কেন্দ্রের চিঠি যাওয়ার পর আগ্রহী নেতারা প্রায় সবাই তৎপর হয়ে উঠেছেন। কিন্তু সমস্যা হলো, যাঁরা বাইরে আছেন তাঁরাই কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন। সুযোগ পেয়ে কোথাও কোথাও তাঁরা মেয়াদ উত্তীর্ণ না হওয়া সত্ত্বেও কমিটি ভেঙে দেন। আর বন্দি বা পলাতক নেতারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না।

এ অবস্থায় আন্দোলনে কার অবদান আছে আর কে সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছে এ নিয়ে দলে নতুন করে বিতর্ক দেখা দিয়েছে; পুনর্গঠন প্রক্রিয়ায় দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। কারাগারের বাইরে থাকা নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সরকারের সঙ্গে আঁতাত করেছেন বলেই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। কারাগারে বা আত্মগোপনে থাকা নেতারা তাঁদের সরকারের 'দালাল' অভিহিত করছেন। তাঁরা আবার কমিটি পুনর্গঠনের জন্য সক্রিয় বা প্রকাশ্য হতে পারছেন না। সক্রিয় হচ্ছেন বাইরে থাকা নেতারাই।

সূত্র জানায়, এই দ্বন্দ্ব-বিতর্কই পুনর্গঠনজনিত কোন্দলের কারণ। এটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। স্থানীয়ভাবে এর অবসান অসম্ভব হয়ে পড়ছে। ফলে দ্বন্দ্বে জড়িত পক্ষগুলো দেনদরবার করতে ঢাকায় আসছে।

ঢাকায় আনাগোনা : গত কয়েক দিনে মাদারীপুর, দিনাজপুর, কিশোরগঞ্জ, শরীয়তপুর, বরগুনা, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও আরো কয়েকটি জেলার এবং সেগুলোর অন্তর্ভুক্ত উপজেলার নেতাদের গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে তদবির করতে দেখা গেছে। তারা ঢাকায় এসে অবস্থান করছেন। কেউ কেউ যুগ্ম মহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহানের বাসায় গিয়েও পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন বলে জানা গেছে।

বেশ কয়েকটি জেলার নেতাদের তদবির করতে দেখা গেছে স্থায়ী কমিটির নেতাদের বাসায় বাসায়। অবশ্য এবার দল পুনর্গঠনের ব্যাপারে স্থায়ী কমিটির নেতাদের তেমন কিছু করার নেই। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিদেশে থাকায় পুনর্গঠনের বিষয়টি কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বয় করছেন যুগ্ম মহাসচিব মোহম্মদ শাহজাহান। কিন্তু তিনিও সুষ্ঠুভাবে এ কাজ করতে পারছেন না। কারণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়া নেতারা গুলশান কার্যালয়ে সরাসরি খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে নিজেদের অনুকূলে কথা বলছেন বা কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে লবিং করছেন। ফলে অনেক কিছুই আটকে যাচ্ছে। অনেক জেলায় পুনর্গঠনের কাজ থেমে গেছে। বেশ কয়েকটি জেলায় সংকট গভীর হওয়ায় চিঠি দিয়ে তাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

বস্তুত এক-এগারোর পর সংস্কার প্রশ্নে বিএনপিতে বিভেদ শুরু হয়। ওই সময় খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ও তাঁর সমর্থকরা প্রভাব বিস্তার করে পকেট কমিটি গঠনে সমর্থ হয়েছিলেন। সংস্কারপন্থী আখ্যা দিয়ে বড় একটি অংশকে বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছিল। মূলত ওই বিরোধই এখনো দলে রয়ে গেছে।

শীর্ষ পর্যায়ে আপত্তি ছিল : পুনর্গঠনের সিদ্ধান্ত বিএনপি চেয়ারপারসন প্রায় এককভাবেই নিয়েছেন। স্থায়ী কমিটির নেতাসহ অনেকেরই এতে মত ছিল না। অনেকে এ প্রক্রিয়া বাদ দেয়ার কথাও বলেছিলেন। তাঁদের যুক্তি- নেতাকর্মীদের জামিনের ব্যবস্থা করাই এ মুহূর্তে জরুরি। তা না করে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয়া হলে নেতাকর্মীরা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়বে। আবার তৎপর হলে সরকার তাদের নতুন করে হয়রানি করবে। একটি সূত্রের দাবি, চিঠির 'ভাষা' নিয়েও অনেকের আপত্তি ছিল। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব চিকিৎসার জন্য এক মাসেরও বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন। অন্য নেতাদের সঙ্গেও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেননি চেয়ারপারসন।

স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিএনপি দুর্বল হয়ে গেছে; দল বলতে এখন আর কিছু নেই- সরকার ও মিডিয়ার এমন প্রচারণার কারণেই পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন খালেদা জিয়া। প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও এ উদ্যোগ নেয়ার উদ্দেশ্য হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দেখানো যে বিএনপি শেষ হয়ে যায়নি। এখনো লাখো-কোটি সমর্থক রয়েছে। তাঁর মতে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়া ৬০-৭০ শতাংশ সম্পন্ন হলেও তা স্বস্তির বিষয়। কারণ, এতেই বিএনপি চাঙা হয়ে উঠবে।-কালের কণ্ঠ
১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে