মঙ্গলবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:২৫:০৬

মানুষ কি এমন মানুষের জন্য হতে পারে না?

মানুষ কি এমন মানুষের জন্য হতে পারে না?

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম : স্বাধীনতার পরপরই যখন আমার আশপাশে মাছি ঘেঁষতেও ভয় পেত তখন একদিন বড় ভাই আমায় প্রকাশ্য রাজপথে অপ্রয়োজনীয় বস্তুর মতো ছুড়ে ফেলেছিলেন, উন্মাদের মতো গালমন্দ করেছিলেন। যার অঙ্গুলি হেলনে লাখো মানুষ জান কোরবান করতে প্রস্তুত, কেবলই পাকিস্তান হানাদারদের পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এরকম এক সময় একজন সংসদ সদস্যের মুক্তিযুদ্ধের এক নেতাকে প্রকাশ্য রাস্তায় ওভাবে গালাগালে দারুণ প্রভাব পড়ার কথা, পড়েছিলও। যখন আমার চোখে ঝলমলে আলো থাকার কথা তখন চোখের পানিতে বুক ভেসে যাচ্ছিল। সহ্য করতে না পেরে মার কাছে গিয়েছিলাম। কী করে যেন মা খবরটা আগেই জেনেছিলেন।

চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে দেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন, 'বাবা বজ্র, সহ্য করতে না শিখলে আল্লাহ তাকে বড় করেন না, ক্ষমতা দেন না। আরজু বড় হলেও সব সময় তুই-ই বড়র দায়িত্ব পালন করেছিস। বাবার মতো ভাইয়ের গালমন্দ সইতে না পারলে বাইরের আঘাত সইবি কী করে? রাস্তায় অমন করেছে বলে তুই আঘাত পেয়েছিস? একজন মুসলমানের লুকানোর কী আছে? আল্লাহ তো সব জানেন, সব দেখেন। তোকে ঘরে গালি দিলে কি এত খারাপ লাগত? কিন্তু সে গালিও আল্লাহ দেখতেন, শুনতেন। আল্লাহকে ভয় না করে মানুষের ভয়ে চিন্তিত হইস না।' মার সেই অমর বাণী সেদিন আবার আমায় নাড়া দিয়েছিল, প্রাক্তন মন্ত্রী বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী যেদিন সংসদে তার পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রথমেই তিনি বলেছেন, 'আমি মুসলমান, আমি বাঙালি, আমি আওয়ামী লীগার।

আমার এ পরিচয় মুছে দেওয়ার মতো কোনো শক্তি পৃথিবীর কারও নেই।' ন্যাড়া বেলতলায় ঠিকই যায়। সব মাছেই খারাপ খায় কিন্তু দোষ হয় শুধু ঘাইরা মাছের। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীকে নিয়ে যেদিন প্রথম কথা ওঠে, বিবেকের তাড়নায় তাকে আল্লাহর কাছে, দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে আহ্বান জানিয়েছিলাম। একজন মুসলমান হিসেবে আমি জানি, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেও তার দয়ার প্রয়োজন। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি সেদিন 'আমি মুসলমান' দৃঢ়কণ্ঠে বলতে পারায় গর্বে বুক ভরে গেছে। কিন্তু আল্লাহ-রসুলকে গালি দিয়ে, মুসলমানের বিধিবিধান-অনুশাসন অস্বীকার করে মুসলমান বললেই কেউ মুসলমান হয় না। সুদূর আমেরিকায় দেওয়া তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেশবাসীর অবশ্যই জানার অধিকার আছে।

তিনি আওয়ামী লীগার, এ জন্য কেউ তাকে গালমন্দ করবে না। আমি আজকের মতিয়া চৌধুরী, ইনু, শাজাহান খানের আওয়ামী লীগের জন্য চিন্তা করি না। আমি হুজুর মওলানা ভাসানী, জননেতা শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের জন্য ভাবী। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতি বয়ে বেড়াতে জীবনপাত করি। তার পদত্যাগে এক নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কতজন কতভাবে খোঁজ করছে, তার ছেড়ে দেওয়া সিটে আমি অংশ নেব কিনা। যদি না নেই তাহলে কী হবে? আর নিলে কী হবে?

তিনি কি মনে করবেন বছরের পর বছর যে জায়গায় তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন তার অবর্তমানে আমাকে কি উপযুক্ত প্রতিনিধি মনে করবেন নাকি অন্য কিছু? ভোট ছাড়া জবরদস্তির সরকার তার কি জনমতের প্রয়োজন আছে? নাকি তাদের গায়ের জোরে সব সিটেই দখল চাই? বাবা-মা না ফেরার দেশে চলে গেছেন বলেই তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা মতামতের কি কোনো দাম নেই? হুজুর মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কত পা টিপেছি। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে এক মহান ফকির শাহ সুফি সামান পাগলের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। কতদিন একসঙ্গে চলেছি। এক বিকালে ফকির বলেছিলেন, 'বঙ্গপীর, চলো বঙ্গবন্ধুকে দেখে আসি।' তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম গণভবনে।

বঙ্গবন্ধুর সামনে বারবার বলছিলেন, 'বঙ্গবন্ধু কই, আমি দেখি না।' বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে চেপে ধরে হু হু করে হেসে বলেছিলেন, 'এই যে আমি আপনাকে ধরে আছি। তাও দেখতে পাচ্ছেন না?' আমার দয়াল ফকির বলেছিলেন, 'না দেখতে পেলে আমি কি মিথ্যা বলব?' তার দুই মাস ক'দিন পর বঙ্গবন্ধু ঘাতকের হাতে নিহত হন। মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, সুফি সাধক সামান ফকির কি আমাকে কিছুই দিয়ে যাননি? কবরবাসী হয়েছেন বলে মা-বাবার ইচ্ছা বা নির্দেশ বুঝতে পারব না? দয়াময় প্রভু আমায় কি এতটুকুও শক্তি দেননি? তাই অনেক প্রশ্ন একটু তো ভাবতেই হবে। ছোট-বড় যাই হোক একটা দল করি। যে দল আমার কাছে সন্তানের মতো প্রিয়। দলীয় নেতা-কর্মীদের মতামত নিতে হবে না? তাই এ পর্বে এ নিয়ে কিছু বলছি না।

ধর্ম, রক্তের বন্ধনহীন অবিচ্ছেদ্য এক সম্পর্কের অবসান ঘটেছে গত ১৮ আগস্ট দিল্লিতে। ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির সহধর্মিণী বিদুষী এক মহাপ্রাণ শ্রীমতী শুভ্রা মুখার্জির মহাপ্রয়াণে আশ্রয়হীন হয়ে তার শেষ প্রার্থনায় দিল্লি গিয়েছিলাম। রবিবার দিল্লি থেকে ফিরেই অনেক কথা শুনলাম। তাই বড় ভাই সম্পর্কে শুরুতেই দু'কথা লিখলাম। বাকিটা পরে লেখার আশা রাখি।

নানা দুঃখ-বেদনা, আনন্দের মধ্যে দীর্ঘ ১৬ বছর নির্বাসনে কাটিয়ে দমদমের নেতাজি সুভাষ বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বাংলাদেশ বিমানে ঢাকা এসেছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা ফেরার দিন বিমানবন্দর লোকে লোকারণ্য ছিল। সেই হয়তো আমার ভাগ্য বিপর্যয়ের মূল কারণ অথবা দেশের মানুষের ভালোবাসায় অভিব্যক্তি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ। আগের রাতের নাটকের কথা নাই-বা বললাম। বাঙালির গৌরব শ্রী জ্যোতি বসু তখন পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী না থাকলে হয়তো কলকাতা ত্যাগ করতে পারতাম না। আমার রক্তবিধৌত বাংলাদেশ, সেই দেশের পবিত্র মাটিতে শক্তভাবে দাঁড়াতে দিতেও কত বাধা। অল্প বয়সে বেশ বোকা ছিলাম, এখনো তার আছর রয়ে গেছে। আমি যখন দেশে ফিরি তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জনতা পার্টির সভাপতি শ্রী চন্দ্রশেখর। সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের কারণে শ্রী চন্দ্রশেখর আমাকে ভাইয়ের মতো দেখতেন। দেশে ফেরার আগের দিন প্রবীণ নেতা জ্যোতি বসুর সঙ্গে রাইটার্সে গিয়ে দেখা করেছিলাম।

তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন, যত কিছুই হোক তার রাজ্য ত্যাগে কেউ ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারবে না। তিনি তার কথা রেখেছিলেন। ঢাকায় লাখো উতলা মানুষ টারমাকে ঢুকে পড়েছিল, সিঁড়ির গায়ে কয়েক হাজার মানুষ। বিমানের শেষ ধাপে নেমে পা কাঁপছিল, জননী জন্মভূমি যাকে মুক্ত করতে রক্ত ঝরিয়েছি তার গায়ে পা রাখব? নাসরীন আমায় শক্ত করে ধরেছিল, 'কী হয়েছে?' বলেছিলাম, এতদিন পর নিজের মাটিতে পা ফেলতে বুক কাঁপছে, বুকের মাঝে তোলপাড় করছে মায়ের বুকে পা রাখব? তাহলে বুকে হেঁটে নামব। বিমানের সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে বুকে হেঁটে ছিলাম।

বিমানবন্দরে গড়াগড়ি খেয়ে আমার ১৬ বছরের সব ব্যথা-বেদনা কর্পূরের মতো উড়ে গিয়েছিল। বাইরে বেরিয়ে যেদিকে তাকাচ্ছিলাম, উদগ্রীব লাখো মানুষ আর মানুষ। আমার জন্য বাংলাদেশ এভাবে উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষায় ছিল কিছুটা ভাবলেও এতটা আশা করিনি। বিমানবন্দর থেকে ৮ ঘণ্টায় বনানী কবরস্থান, শহীদ মিনার হয়ে ৩২-এ পিতার বাড়িতে এসেছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, প্রিয় ভগি্ন, জননেত্রী শেখ হাসিনা গেট খুলে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি ছিলাম বেদনায় মুহ্যমান। বাড়ির আঙিনায় ঢুকতেই আপন ভাইয়ের মতো বুকে আগলে নিয়েছিলেন। দু'হাতে আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে যেভাবে বুকে ধরেছিলেন একমাত্র মায়ের পক্ষে সন্তানকে ওভাবে ধরে রাখা সম্ভব।

বাড়ির সীমানায় পা দিয়ে নিজেকে সামাল দিতে পারছিলাম না। আমার এক প্রিয় কর্মী জামালপুরের মুরাদুজ্জামান বারান্দায় টাইলস দিয়ে বঙ্গবন্ধুর যে প্রতিকৃতি বানিয়েছে তার সামনে দাঁড়িয়েছিলাম। জননেত্রী আমায় সন্তানের মতো ধরেছিলেন। তারপর যে সিঁড়িতে বাংলা, বাঙালির ভাগ্য গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়েছিল সেই সিঁড়ির সামনে আমার আর কোনো হুঁশ ছিল না। প্রায় আধা ঘণ্টা পর ধরে নিয়ে নেত্রীর পাশে ড্রইংরুমে বসানো হয়েছিল। সেখানে আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাই ছিলেন। আমি কেঁদেই চলেছি, দুই চোখের পানি বাঁধ মানছিল না। দুলাভাই ড. ওয়াজেদ মাঝে মাঝে মাথায়, পিঠে, কপালে হাত বুলাচ্ছিলেন, নানাভাবে সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু যে সব হারায় তার সান্ত্বনা কোথায়?

সেই সকালে দমদমের তাজ হোটেল থেকে বেরিয়েছিলাম। রাত তখন ১০টা, কোথায় থাকব সে নিয়ে কথাবার্তা। অনেকেই বলতে চায় ৩২-শেই আমার থাকা উচিত। আমার জন্য সেটা ছিল মৃত্যুদণ্ডের মতো। মোহাম্মদপুরের ২০-৩০ বাবর রোডের যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলাম সেই বাড়িতে নাকি অন্য কেউ থাকে। শেষ পর্যন্ত ছোট বোন শাহানার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আরিফ আহমেদ দুলালের স্যার সৈয়দ রোডের বাড়িতে উঠেছিলাম। চার দিন পর বাবর রোড থেকে দখলদাররা পালিয়ে গেলে সেখানে যাই।

এ বছর ২৮ জানুয়ারি যখন অবিরাম অবরোধ-হরতালে সারা দেশ জ্বলছিল, গাড়িতে গাড়িতে বোমা, তখন বিরোধী দলনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি শান্তির আহ্বান জানিয়ে মতিঝিলের ফুটপাথে মাদুর বিছিয়ে একটানা দুই মাস চার দিন অবস্থানে ছিলাম। ৬৫ দিনের দিন প্রথম গিয়েছিলাম হুজুর মওলানা ভাসানীর মাজার জিয়ারতে, সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর কবরে, তারপর দেশের নানা স্থানে আজ ২২৫ দিন ঘুরে বেড়াচ্ছি। একপর্যায়ে অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহর কাছে ঢাকায় এসেছিলাম স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে। নিজের বাড়ি বাবর রোডে থাকব না, তাই ঢাকায় কোথায় থাকব। আবার সেই দুলাল, শাহানার স্যার সৈয়দ রোডের বাড়ি। হঠাৎই সেদিন ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জি ইহলোক ত্যাগ করেন। প্রায় ৩৫ বছর মুখার্জি পরিবারের সঙ্গে আমার একটা আত্দিক সম্পর্ক। সেখানে দেনা-পাওনার কোনো লেশ নেই।

১৮ আগস্ট সকালে গীতা মুখার্জি ইহলোক ত্যাগ করায় ভারতে আমার একটা নিরাপদ আশ্রয় হারিয়ে যায়। পরদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার শেষকৃত্যে অংশ নিয়েছিলেন। আমি গিয়েছিলাম টুঙ্গিপাড়া পিতার কবরে ফাতেহা পাঠ করতে। এক বুক শঙ্কা নিয়ে দুদিন পর ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে ফোন করেছিলাম। আমার স্ত্রী তার সঙ্গে কথা বলে কাঁদছিল। কান্না শুনে দাদাই সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, 'নাসরীন, তুমি কেঁদো না। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে থাকার চেয়ে স্বর্গবাসী হয়েছে, সেই ভালো। তোমরা তার জন্য দোয়া করো। আর পারলে বাঘাকে পাঠিয়ে দিও।' তাই গিয়েছিলাম ভারতের রাজধানী দিল্লিতে।

২৮ আগস্ট শুক্রবার ছিল মানবদরদী, মাথা থেকে পা পর্যন্ত একজন খাঁটি বাঙালি শ্রীমতী শুভ্রা মুখার্জি গীতাদির শ্রাদ্ধ বা শেষ প্রার্থনা। আমি ২৭ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুরে দিল্লি গিয়েছিলাম। ওই রাতেই মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা। আমাকে দেখেই তিনি বলেছিলেন, 'তুমি এসেছ খুব খুশি হয়েছি। ভেবেছিলাম তুমি হাসিনা, রেহানার সঙ্গেই আসবে। যাই হোক প্রার্থনায় এসেছ তাই কম কী!' দিদির সম্পর্কে প্রায় এক ঘণ্টা স্মৃতিচারণ হয়। উইলিংডন হসপিটাল যা এখন রামমনোহর লোহিয়া সরকারি হাসপাতাল। ডাক্তার মল্লিক এবং তার স্ত্রী মল্লিকার বাড়িতে দেখা থেকে কত কথা। কীভাবে সময় কেটে যায় বুঝতেই পারিনি।

সাপ্তাহিক লেখায় গীতাদি সম্পর্কে লিখেছিলাম। লেখাটি হাতে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। সেদিনই গভীরভাবে লক্ষ্য করলাম একজন পাঠক যখন আগ্রহ নিয়ে লেখা পড়ে তখন লেখকের কত আনন্দ লাগে। আর অমন জ্ঞানী-গুণী বিশাল পাঠক যদি কারও লেখা নিবিষ্ট মনে পড়ে তখন কতটা আনন্দ হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ১৫ মিনিট এক মনে লেখাটি পড়েছিলেন। মাঝে হঠাৎ বললেন, 'তোমাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান জানিয়েছিল?' বলেছিলাম, হ্যাঁ। মানুষটি বড় ভালো। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, 'তাকে আমি চিনি। আমার সঙ্গে দেখা হয়েছে।' পড়া শেষ করে একটা লম্বা শ্বাস ফেলে বললেন, 'গুড, খুব ভালো হয়েছে।' সঙ্গে সঙ্গে মুন্নীকে ডাকলেন, 'মুন্নী, তোর বাঘা কাকু তোর মায়ের ওপর একটা চমৎকার লেখা লিখেছে।

এই নে ধর।' চলে আসার সময় তার সদ্য প্রকাশিত ‘THE DRAMATIC DECADE- The Indira Gandhi Years’ বইটিতে ‘To Bagha whom I know for many many years since the days of his stay in India in seventies onwords.’ লিখে বইটি আমার হাতে তুলে দিলেন। বড় ভালো লাগল। অমন আপনজন ক'জন হয়। প্রথম ভেবেছিলাম গীতা দিদির প্রার্থনা ৩২০ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ৩৪০ কামরার রাষ্ট্রপতি ভবনের আঙিনাতেই হবে। পরে শুনলাম না, বহু স্মৃতিবিজড়িত ১৩ তালকাটরা রোডে হবে। বাংলাদেশ থেকে তেমন কেউ গেছে বলে মনে হলো না। জুমার নামাজের দিন ছিল বলে ১টার দিকে যখন চলে আসি তখন রাষ্ট্রদূতকে দেখলাম। মার্সিডিজ গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা না থাকলে মহামান্য দূতকে চিনতে পারতাম না। আমি যখন যাই সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দাদার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তিনি টেনে পাশে বসিয়েছিলেন। তারপর মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি মুন্নী যেখানে শ্রাদ্ধের মন্ত্র পাঠ হচ্ছিল সেখানে নিয়ে যায়। মন্ত্র পড়ছিল পুরোহিতরা।

অর্চনা করছিল মাথা ন্যাড়া করা বড় ছেলে অভিজিৎ মুখার্জি এমপি ও ইন্দ্রজিৎ মুখার্জি। প্রথম প্রথম অভিজিৎ ও ইন্দ্রজিৎকে ন্যাড়া অবস্থায় চিনতে পারিনি। অভিজিৎ আগের মতোই আছে কিন্তু পিন্টু অনেক মোটা হয়ে গেছে। যেখানে পূজা হচ্ছিল বেশ কয়েক বছর আগে সেখানে খাবার আগে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে কত গল্প করছিলাম। আজ সেই মানুষটি নেই। তাই একেবারেই ভালো লাগছিল না, দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার ডান পাশে বসেছিলেন কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক আনন্দ শর্মা। তারপর কেন্দ্র শাসিত দিল্লির নির্বাচনে যিনি সারা ভারতকে চমক দেখিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন সেই আম আদমি পার্টির প্রাণ অরবিন্দ কেজরিওয়াল।

নেপালের প্রেসিডেন্ট রামভরণ যাদবের ছেলে এমপি যাদব বামপাশে বসেছিলেন। আরও কতজন আসছিলেন যাচ্ছিলেন লক্ষ্য করার মতো মনের অবস্থা ছিল না। অনেকক্ষণ নিবিষ্ট মনে বসেছিলাম আর ভাবছিলাম যার সঙ্গে রক্তের কোনো সম্পর্ক ছিল না, ধর্মের ছিল না তারপরও তাকে নিয়ে মনের ভিতর এত তোলপাড়, এত আলোড়ন কেন? তবে কি সে কথাই সত্য, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। নানা ধর্মের পরও মানব ধর্ম বলে একটা ধর্ম আছে। মনে হচ্ছিল এ জন্যই তো বিপ্লবী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখতে পেরেছিলেন, 'অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ,/ কাণ্ডারী! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি-পণ!/ 'হিন্দু না ওরা মুসলিম?' ওই জিজ্ঞাসে কোন্ জন?/ কাণ্ডারী! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মা'র!'

শেষকৃত্যে যেতে পারিনি তাতে মনে যে ব্যথা ছিল প্রার্থনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে পেরে সব দুঃখ-বেদনা নিমিষে ভুলে গিয়েছিলাম। পরদিন গিয়েছিলাম খাজা গরিবে নেওয়াজের আজমিরে। এবার বড় বেশি ভালো লেগেছে, বড় শান্তি পেয়েছি খাজা বাবার কবর জিয়ারত করে। এমন ভালো আগে খুব একটা লাগেনি যেমনটা এবার লেগেছে। ফেরার পথে আবার গিয়েছিলাম রাষ্ট্রপতি ভবনে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। দিদির ঘরে গিয়েছিলাম। একেবারে কেমন যেন খালি খালি লাগছিল আর মনে হচ্ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলাম কবিগুরুর বিয়োগ ব্যথায় ব্যথিত হয়ে লিখেছিলেন-

'সেই পথ, সেই পথ-চলা গাঢ় স্মৃতি,

সব আছে! নাই শুধু সেই নিতি নিতি

নব নব ভালোবাসা প্রতি দরশনে,

আরো প্রিয় ক'রে পাওয়া চির প্রিয়জনে-

আদি নাই, অন্ত নাই, ক্লান্তি তৃপ্তি নাই,-

যত পাই তত চাই- আরো আরো চাই,-

সেই নেশা, সেই মধু নাড়ী-ছেঁড়া টান

সেই কল্পলোকে নব নব অভিযান,-

সব নিয়ে গেছ বন্ধু! সে কল-কল্লোল,

সে হাসি-হিল্লোল নাই চিত-উতরোল!

আজ সেই প্রাণ-ঠাসা একমুঠো ঘরে

শূন্যের শূন্যতা রাজে, বুক নাহি ভরে!-বিডিপ্রতিদিন
লেখক : রাজনীতিক।
৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে