বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০১:২৫:০৫

যেসব সব কারণে হতাশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

যেসব সব কারণে হতাশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

সাখাওয়াত কাওসার : ১৫ জুন। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে সঙ্গীয় ফোর্স নিয়ে ডিউটি করছিলেন শ্রীনগর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) জহিরুল ইসলাম। ওই সময়ই একটি রেজিস্ট্রেশনবিহীন মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা অনিক। সিগন্যাল দিয়ে গাড়ির কাগজপত্র চাইতে গেলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠেন অনিক। ওই পুলিশ সদস্যকে বলতে থাকেন, 'তুই আমাকে চিনিস না? তোরে এ থানায় পাঠাইছে কে? দেখে নিব।

এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্য জহিরুলের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে তাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যান অনিক। পরে অনিককে গ্রেফতার করতে পুলিশ অভিযান চালালে সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সামসুজ্জামানকে ১৫ দিনের মধ্যে অপসারণের প্রকাশ্য হুমকি দেন সংসদ সদস্য সুকুমার রঞ্জন ঘোষ।

এর মাত্র তিন দিন পর ১৮ জুন চোরাই মোটরসাইকেলসহ শ্রীনগর বাজারের পাশর্ববর্তী এলাকায় এক ব্যক্তিকে আটক করেন শ্রীনগর থানার এসআই রেজাউল ইসলামের নেতৃত্বাধীন একটি দল। এ অপরাধে এসআই রেজাউলকে শ্রীনগর বাজার থেকে লাউড স্পিকারে ফোন করে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এমপি সুকুমার রঞ্জন ঘোষের কথিত এপিএস শ্রীনগর উপজেলা যুবলীগের বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক সুজন। পরে তার নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত ওই পুলিশ সদস্যের ওপর হামলা চালিয়ে মোটরসাইকেল ছিনিয়ে নেয়।

এত গেল কেবল একটি এলাকার চিত্র। শুধু আসামি গ্রেফতার কিংবা ছাড়িয়ে নেয়া নয়, পুলিশবাহিনীতে বিভিন্ন নিয়োগের জন্য ক্ষমতাসীন দলের এমপিদের পাঠানো তালিকা অনুযায়ী কাজ না হলেই সংশ্লিষ্ট জেলার পুলিশ সুপারদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। নানা ধরনের অভিযোগ আনছেন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

অন্যদিকে, ক্ষমতাসীন দলের অন্তঃকোন্দলের কারণে সংঘটিত ঘটনাগুলোর জন্য রীতিমতো বিব্রত র‌্যাব-পুলিশ।

এর বাইরে দলীয় পরিচয় বহনকারী অপরাধীদের অবৈধ অস্ত্র কিংবা বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের হাতে হাতে আটক করলেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা বিব্রতবোধ করছেন। এক পর্যায়ে তাদের ছেড়ে দিতেও বাধ্য হচ্ছেন। এসব বিষয় সরকারের উচ্চ পর্যায় অবহিত হওয়ার পরও কোনো প্রতিকার হচ্ছে না বলে অভিযোগ করছেন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা। স্থবিরতা চলে এসেছে বাহিনীর অপারেশনের ক্ষেত্রে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন এ অবস্থা চলতে থাকলে দেশে আইনের শাসন বলে কিছু থাকবে না। দলীয় পরিচয় বিবেচনা করে অপরাধীকে দেখা হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এ প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, পুলিশে নিয়োগে নানা অনিয়মের ব্যাপারে তদন্ত হয়েছে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এর বাইরে র‌্যাব-পুলিশ হতাশ এটা ঠিক নয়। অপরাধীকে অপরাধী হিসেবেই দেখা হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৭ আগস্ট রাজধানীর হাজারীবাগ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি মো. আরজু র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যাওয়ার পরই পাল্টে যেতে থাকে চিত্র।

র‌্যাব-২-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মাসুদ রানাসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করার জন্য আবেদন করেন নিহতের বড় ভাই মাসুদ রানা। পরে আদালত ঘটনাটির বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দেন। শুধু তাই নয়, হাজারীবাগ থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাজী মাঈনুল ইসলামকে ওই থানা থেকে ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার করা হয়।

এর পর থেকে র‌্যাব ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা হতাশ। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ঊধর্বতন কর্মকর্তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, সত্যিই খুব অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মধ্যে আছি। কোনো অপরাধের তদন্ত নিয়ে কাজ করলেই পদে পদে বাধা। দলীয় লোক হলে তো কথাই নেই। খোদ এমপি কিংবা দলের কোনো প্রভাবশালী নেতার ফোন। তাদের কথা অনুযায়ী কাজ না করলে মুহূর্তেই ওই অফিসারকে জামায়াত-শিবির কালিমা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। এটা সত্যিই খুব কষ্টের।

পুলিশ সদর দফতর সূত্র জানায়, ২৩ জুলাই মাগুরা শহরের দোয়ারপাড়া এলাকায় মাগুরা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ভূঁইয়া ও ছাত্রলীগ কর্মী আজিবর শেখ গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের নেপথ্যে ছিল প্রধানমন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস-২) সাইফুজ্জামান শিখর এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বীরেন শিকদারের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ। মূলত এ দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাগুরায় সংঘাত ও খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। পুলিশের বিশেষ শাখার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে এসব বিষয় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করা হয়।

দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের কারণে বিভিন্ন অপরাধের তদন্তে রীতিমতো বিব্রতবোধ করেন র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা। প্রায় একই অবস্থা ঝিনাইদহ জেলায়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী আবদুল হাই (বর্তমান সংসদ সদস্য) এবং আওয়ামী লীগ নেতা শৈলকুপা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান নায়েব জোয়ার্দারের মধ্যকার দ্বন্দ্বে রীতিমতো বিব্রত পুলিশ প্রশাসন।

এর বাইরে এমপি গ্রুপের শৈলকুপা উপজেলার বর্তমান চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন ওরফে সোনা শিকদারের তদবিরে রীতিমতো অতিষ্ঠ জেলা পুলিশ। এর বাইরে সম্প্রতি শেষ হওয়া কনস্টেবল নিয়োগ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যদের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে।

এর মধ্যে রাজবাড়ী, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঠাকুরগাঁও, গাইবান্ধা, কঙ্বাজার ও মৌলভীবাজার জেলায়ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও অর্থ লেনদেন নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার এমপি এবং আওয়ামী লীগের নেতারা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। অনেক এমপি সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমকে তাদের প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন। এর মধ্যে ১৪ মার্চ রাজবাড়ী প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ কাজী কেরামত আলী ও সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য চৌধুরী কামরুন নাহার লাভলী। সংবাদ সম্মেলনে একাত্দতা প্রকাশ করে মুঠোফোনে বক্তব্য দেন রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মো. জিল্লুল হাকিম।

পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা জানান, নিয়োগে অনিয়ম নিয়ে বেশির ভাগ অভিযোগই এসেছে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে। একটি জেলার নাম প্রকাশ না করে তিনি বলেন, তদন্তে দেখা গেছে, ওই জেলার একজন সংসদ সদস্য ৫০ জনকে নেওয়ার জন্য তালিকা দেন পুলিশ সুপারকে (এসপি)। নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তারা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, ৫০ জনের মধ্যে ছয়জনের বাড়িই অন্য জেলায়। ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে তাদের চাকরি দেওয়ার জন্য তালিকা পাঠানো হয়।

এ জন্য মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়েছে। বিষয়টি ধরা পড়ায় এবং যোগ্যতা না থাকায় তালিকার অনেকের চাকরি হয়নি। চাকরি না হওয়ায় সংশ্লিষ্ট জেলার এসপির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অপরাধ বিশেষজ্ঞ শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন প্রতিবেদককে বলেন, জনগণের আস্থা ধরে রাখতে সরকারের উচিত এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা। অপরাধী যত বড় নেতাই হোক না কেন তাকে অপরাধী হিসেবে দেখতেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। এতে জনপ্রিয়তা বাড়বে, কমবে না।-বাংলাদেশ প্রতিদিন
৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে