বুধবার, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:১২:২২

ভয়াবহ রূপ ধারণ করে পাল্টে যাচ্ছে জেলার মানচিত্র!

ভয়াবহ রূপ ধারণ করে পাল্টে যাচ্ছে জেলার মানচিত্র!

নিউজ ডেস্ক : নদী ভাঙন দেশে দিন দিন ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। বড় বড় নদীগুলোর গর্ভে প্রতিদিন বিলীন হয়ে যাচ্ছে শত শত একর জমি। কোথাও কোথাও ভাঙন এত তীব্র আকার ধারণ করেছে যে, বিভিন্ন জেলার মানচিত্র এখন পাল্টে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত ভূমিহীন হচ্ছে কত শত মানুষ। কমে আসছে দেশের ফসলী জমির পরিমাণ। বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় শহর রক্ষা বাঁধ নির্মিত হলেও কাজে ফাঁকিবাজির ফলে ওইসব বাঁধ টেকসই হচ্ছে না। বন্যার তোড় একটু প্রবল হলেই ভেঙে যাচ্ছে এসব বাঁধ। দেশে গত কয়েকদিন ধরে চলমান বন্যায় একই অবস্থা লক্ষ্য করা যাচ্ছে একাধিক জেলায়।

মেঘনার ভাঙনে চাঁদপুর ও ভোলায় শহর রক্ষা বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গাইবান্ধা রক্ষা বাঁধের এক জায়গায় প্রায় একশো মিটার ভেঙে পানিতে মিশে গেছে।এদিকে চলমান বন্যা পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতি মঙ্গলবারও অব্যাহত ছিল।মেঘনার ভাঙনে ভোলার মানচিত্রে পরিবর্তননাছিম উল আলম জানান, প্রমত্তা মেঘনার ভাঙনে দেশের বৃহত্তম ব-দ্বীপ জেলা ভোলার মানচিত্রে পরিবর্তন ঘটছে। প্রতিবছর বাস্তুচ্যুত হচ্ছে হাজার-হাজার নারী ও শিশুসহ অগণিত মানুষ। নদী গ্রাস করছে বিপুল ফসলী জমি। হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে।

বারবারই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে ভোলা-লক্ষ্মীপুর ফেরি সার্ভিস। ফলে দেশের দু’টি সমুদ্র বন্দরসহ চট্টগ্রাম-বরিশাল ও খুলনা বিভাগের সরাসরি সড়ক যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। গত দেড় মাসে তিন দফায় এ ফেরি সার্ভিস বন্ধ হয়েছে। বর্তমানেও বন্ধ। পানি উন্নয়ন বোর্ড ভোলা শহরসহ এ জেলার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো রক্ষায় যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। দ্বীপ জেলা ভোলা দেশের সর্ববৃহৎ ব-দ্বীপ। জেলার পূর্ব ও উত্তর পাশে মেঘনা আর পশ্চিমে তেঁতুলিয়া নদী। দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। উজান থেকে সাগরমুখী ঢলের পানির অন্ততঃ ৩০ ভাগ এ দু’টি নদী দিয়ে সাগরে প্রবাহিত হয়ে থাকে। আর এ প্রবাহ সর্বস্বান্ত করে দিয়ে যাচ্ছে ভোলাকে। এছাড়াও ’৭০ ও ’৯১-এর দু’টি ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ও ভোলার জনজীবনকে ল-ভ- করে দিয়ে গেছে।

এ দু’টি ঝড়ে গোটা ভোলাতে কোন টিনের ও কাঁচা ঘরবাড়ী অবশিষ্ট ছিল না। ’৭০-এর ঘূর্ণিঝড় ‘হেরিকেন’-এর তা-বে ভোলায় দেড় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। নিখোঁজও হয় অগণিত। এছাড়াও ছোট ও মাঝারী যেকোন ঘূর্ণিঝড়সহ জলোচ্ছ্বাসেও ভোলার জনজীবন বারবারই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। হাজার-হাজার পরিবার বাস্তুহারা হচ্ছে প্রতি বছর। এখনো কয়েক লাখ ভিটেমাটি হারা মানুষ ভোলার বিভিন্ন বেড়িবাঁধ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ওপর মানবেতর জীবনযাপন করছে। গত মাস দু’য়েক যাবত মেঘনার ছোবলে ভোলার সর্ব উত্তরে ইলিশা এলাকায় পরিস্থিতি ভয়াবহ। এখানে তিন দফায় ফেরিঘাট বিলীন হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রায় ৪০ হাজার জিওব্যাগ ফেলেও ভাঙন প্রতিরোধ করতে পারে নি। ইতোমধ্যে ওই এলাকায় ৫শ’ মিটার ব্যসে প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকাকে মেঘনা গ্রাস করেছে।

এখানে প্রমত্তা মেঘনা একটি রিং বাঁধও ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাট কোন ভাবেই টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বসতভিটা হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৭শ’ পরিবার। এসব পরিবারকে অবশ্য সরকার কিছু নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ গত সোমবার এসব নগদ অর্থ সহায়তা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে বিতরণও করেছেন। মেঘনার ছোবলে ভোলার সদর উপজেলার কাঁচিয়া ও ধনিয়া ছাড়াও তজুমদ্দিন উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়ন এবং চরফ্যাশনের চর মাদ্রাজ এলাকার ভাঙন পরিস্থিতি ভয়াবহ। গোটা ভোলাই মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার ভাঙনে বিপর্যস্ত।

তবে এসব ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের যেসব কর্মকাণ্ড চলছে, তার বিস্তারিত কোন তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি। মঙ্গলবার বরিশাল জোনের প্রধান প্রকৌশলী, ভোলার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীসহ কোন নির্বাহী প্রকৌশলীকেও টেলিফোন ও তাদের সেল ফোনে পাওয়া যায় নি। তবে নদী গবেষণার সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক বিশেষজ্ঞ মহল গোটা ভোলাকে মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার হাত থেকে রক্ষায় পরিপূর্ণ তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ‘মডেল স্ট্যাডি’ করার তাগিদ দিয়েছেন।

আর ঐসব স্ট্যাডির ভিত্তিতেই ভোলাকে এসব নদীর ভাঙন থেকে রক্ষায় স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী পদক্ষেপ গ্রহণেরও তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ মহল। নচেৎ একদিকে নদী ভাঙনে সরকারী-বেসরকারী স্থাপনা যেমনি বিলুপ্ত হবে, অপরদিকে হাজার হাজার পরিবারও উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে বলে মনে করছেন মহলটি। অপরদিকে নদী ভাঙন রোধের নামে সরকারী অর্থের অপচয় ও লুটপাট বন্ধ হবে না বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। নদী ভাঙন ভোলার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকেও ক্রমশঃ পেছনে নিয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

এসব বিষয়ে মঙ্গলবার ভোলার ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের সাথে আলাপ করা হলে তিনি জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও এলজিইডি’র মাধ্যমে ভাঙন প্রতিরোধে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। যত দ্রুত সম্ভব ভাঙন রোধ করে ফেরি সার্ভিস পুনর্বহালসহ ইলিশা লঞ্চঘাট চালুর লক্ষ্যে কাজ চলছে বলে তিনি জানান। এসব বিষয় জেলা প্রশাসনের তরফ থেকেও নিয়মিত মনিটরিং করার কথা জানান তিনি। পাশাপাশি জেলার অন্যান্য এলাকাগুলোতেও যথাযথ গুরুত্বের সাথে ভাঙন রোধ কার্যক্রম গ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন জেলা প্রশাসক।

চাঁদপুরে শহর রক্ষা বাঁধে তীব্র ভাঙনবি এম হান্নান, চাঁদপুর থেকে জানান, কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের পুরানবাজারে মেঘনার ভাঙনে ১শ’ মিটার এলাকা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভাঙনের মুখে পড়া ১০টি বসতঘর দ্রুত সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এখনো শতাধিক ঘরবাড়ি হুমকির মুখে রয়েছে। গত সোমবার দিবাগত রাত সোয়া ১টা থেকে শুরু হওয়া ভাঙনে শহর রক্ষা বাঁধের হরিসভা এলাকার কয়েক শ’ সিসি ব্লক ঘূর্ণায়মান স্রোতের টানে নদীতে তলিয়ে গেছে। ভাঙনস্থলে বর্তমানে পানির গভীরতা প্রায় ৭০ ফুট। ফলে তড়িঘড়ি করে ভাঙন প্রতিরোধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন পাউবো কর্মকর্তারা।

মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত অর্থাৎ ভাঙন শুরুর ১৮ ঘণ্টা অতিবাহিত হলেও প্রতিরোধ ব্যবস্থা না নেয়ায় ভাঙনের পরিধি ক্রমশঃ বাড়ছে। জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পেলে ভাঙনের তীব্রতা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছে স্থানীয়রা। ফলে ওই এলাকার মানুষ আতঙ্কে তাদের বসতঘর সরিয়ে নিচ্ছে। একটি মসজিদ, হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকটি মন্দিরসহ কয়েক শ’ বসতবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রয়েছে হুমকির মুখে। ভাঙন কবলিত হরিসভা এলাকার বাসিন্দাদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ড লাল পতাকা টানিয়ে সতর্ক করে দিয়েছে। সাধারণ্যের অবাধ চলাফেরা ঠেকাতে সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, পৌর মেয়র এবং পানি উন্নয়নের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দিয়েছেন।

চাঁদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, চাঁদপুর শহর সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় ১৯৭২ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নতুন বাজার ও পুরানবাজারের নদী তীরবর্তী ৩ হাজার ৩শ’ ৬০ মিটার এলাকা সংরক্ষণ করা হয়। এতে ব্যয় হয় ১শ’ ৪০ কোটি ৩০ লক্ষ টাকা। এ ছাড়া চলমান প্রকল্প হিসেবে ৩য় পর্যায়ে বিশেষ করে পুরানবাজার হরিসভা এলাকায় ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আরো ১ হাজার ৪শ’ ৮০ মিটার এলাকা সংরক্ষণ করা হয়। তাতে ব্যয় হয় ২৪ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। এছাড়াও গত বছর শহর রক্ষা বাঁধের নতুন বাজার বড় স্টেশন মোলহেড এলাকায় ভাঙন দেখা দিলে সংরক্ষণে ব্যয় হয় ১ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জানান, সিসি ব্লক ও জিওব্যাগ প্রস্তুত রয়েছে। কিন্তু শ্রমিক ও বালি সঙ্কটে তাৎক্ষণিক ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে পারছি না। তবে ইতোমধ্যে রংপুর ও সিরাজগঞ্জ থেকে শ্রমিক ও মতলবের দশআনি থেকে বালি আনা হচ্ছে। আসা মাত্রই কাজ শুরু করা যাবে। স্থানীয়রা জানায়, গত বছরও চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের মোলহেড এলাকায় ভাঙন দেখা দেয়। সে সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিলে বন্ধ হয়ে যায় ভাঙন। তারা জানায়, বর্ষাকাল শুরুর প্রথম থেকেই অর্থাৎ গত তিন মাস আগ থেকেই সেখানে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা দেখা গিয়েছিল। তাৎক্ষণিক বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে অবহিত করা হলেও তারা ব্যবস্থা নেয় নি।

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডল প্রতিবেদককে জানান, শহর রক্ষা বাঁধের পুরানবাজারে হঠাৎ মেঘনার ভাঙনের বিষয়ে সরকারকে অবহিত করেছি। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর জরুরী বার্তা পাঠানো হয়েছে। সেই সাথে পানি সম্পদ মন্ত্রীর সাথে কথা বলেছি। আশা করছি দ্রুত ভাঙন রোধে পদক্ষেপ নেয়া হবে।চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্সের সহ-সভাপতি সুভাষ চন্দ্র রায় জানান, ১২৫ কেজি ওজনের জিওব্যাগে বালিভর্তি করে ভাঙন প্রতিরোধের যে উদ্যোগ নিচ্ছে পাউবো তাতে কাজ হবে না। প্রয়োজন হবে ২৫০ কেজি ওজনের জিও ব্যাগের।

তিনি বলেন, মেঘনার ভাঙন রোধে ব্যবস্থা নিতে বিলম্ব হলে মসজিদ, মন্দিরসহ প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যাবে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অতিরিক্ত মহা-পরিচালক আবদুল লতিফ মিয়া, কুমিল্লা অঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মোসাদ্দেক মঙ্গলবার দুপুরে চাঁদপুরে ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেন।

এ সময়ে তারা সংবাদিকদের জানান, উজানের তীব্র পানির চাপে ভাঙনের তীব্রতা আরো ব্যাপক হতে পারে, তাই জরুরী ভিত্তিতে সিসি ব্লক ফেলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ৩শ’ কেজি ওজনের ব্লক ফেলার দক্ষ শ্রমিক চাঁদপুরে নেই। তাই সিরাজগঞ্জ থেকে দক্ষ শ্রমিক আসলেই ভাঙ্গন প্রতিরোধ কার্যক্রম শুরু হবে। তাদের ধারণা আজ বুধবার সকাল নাগাদ কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।

গাইবান্ধা শহর রক্ষা বাঁধের ৮০ ফুট ভেঙে গেছে গাইবান্ধা জেলা সংবাদদাতা জানান, ঘাঘট নদীর বন্যার পানির তোড়ে গোদারহাট সংলগ্ন গাইবান্ধা শহর রক্ষা সোনাইল বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের প্রায় ৮০ ফুট এলাকা মঙ্গলবার সকালে আকস্মিকভাবে ভেঙে যায়। এতে গাইবান্ধা পৌর এলাকাসহ সদর উপজেলার খোলাহাটি, বোয়ালী, বাদিয়াখালী, রামচন্দ্রপুর, ফুলছড়ির উদাখালী, কঞ্চিপাড়া, গজারিয়া এবং উড়িয়া ইউনিয়নের ৩২টি গ্রাম ব্যাপকভাবে বন্যা কবলিত হয়ে পড়ে।

ওইসব এলাকার কয়েক হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন, বীজতলা, শাক-সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে এবং মাছের খামারের পুকুরগুলো উপচে চাষকৃত সব মাছ পানিতে ভেসে গেছে। এই অসময়ে বাঁধ ভাঙা পানিতে আমন ধান ও বীজতলা তলিয়ে যাওয়ায় আর কোন চাষের সুযোগ না থাকায় কৃষকরা চরম বিপাকে পড়েছে। মাছ চাষিরাও পড়েছে চরম বিপাকে। বন্যা কবলিত অসহায় মানুষ ধান, চাল বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রসহ হাঁস-মুরগি ও গরু-ছাগল নিয়ে দ্রুত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়ে খোলা আকাশের নিচে এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে।

খোলাহাটি ইউপি চেয়ারম্যান জানান, ঘাঘট নদী থেকে ট্রাক্টর (কাঁকড়া) দিয়ে বালু তোলার জন্য বাঁধ কেটে রাস্তা তৈরী করে এক শ্রেণীর প্রভাবশালী বালু ব্যবসায়ীরা আইনের তোয়াক্কা না করেই দীর্ঘদিন থেকে বালু উত্তোলন করে আসছিল। গুরুত্বপূর্ণ এই শহর রক্ষা বাঁধটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে এ বিষয়ে একাধিকবার অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও তারা বাঁধ সংস্কার এবং উন্নয়ন বা বালু উত্তোলন বন্ধে কোন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।

ফলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের চরম গাফলতি খামখেয়ালীর কারণেই ঘাঘটের পানি বৃদ্ধি পেলে বাঁধ চুইয়ে পড়ে বাঁধটি ভেঙে যায়। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আউয়াল বলেন, সোনাইল বাঁধ অন্যান্য বাঁধের তুলনায় অনেক শক্তিশালী। বাঁধটি দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছিল। কিন্তু তাকে বিষয়টি না জানানোর ফলে আকস্মিক এই দুর্ঘটনাটি ঘটে। এদিকে পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারে বা জরুরী ত্রাণ সহায়তা প্রদানে তাৎক্ষণিক সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা সমূহের কোন ত্রাণ তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড আরও জানায়, মঙ্গলবার ব্রহ্মপুত্র ও ঘাঘট নদীর পানি কিছুটা হ্রাস পেলেও এখনও ব্রহ্মপুত্র বিপদসীমার ৪৬ সে.মি. এবং ঘাঘট বিপদসীমার ৩৪ সে.মি. উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

অপরদিকে করতোয়া ও তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেলেও বিপদসীমার সামান্য নিচে রয়েছে। কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত:শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর পানি সামান্য হ্রাস পেলেও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে দুর্ভোগ বেড়েছে ৬ লক্ষাধিক বানভাসীর। নৌকা, কলাগাছের ভেলা ও বাঁশের মাচানে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে হাজার হাজার বানভাসী। বন্যা কবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগ।

গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেওয়ায় গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছে বানভাসীরা।কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার নয়ার চরের আমেনা বেগম জানান, ১৫-১৬ দিন থেকে দুর্ভোগে আছি। ছোওয়া পোয়াক খাওয়াইতে পারি না। রান্না করতে পারি না। ঘরে খাবার নাই। কোন বার এতদিন পানিতে বাড়ী-ঘর তলিয়ে থাকে এর আগে দেখি নাই।টানা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়ে আছে জেলার ২ হাজার ১শ’ বর্গকিলোমিটার এলাকার ৬৮ ইউনিয়নের ৬ শতাধিক গ্রাম।এদিকে, কুড়িগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণ বিতরণ কাজ জোরদার করেছেন স্থানীয় প্রশাসন।

মঙ্গলবার সকালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী চিলমারীর চর বড়ভিটায় ত্রাণ বিতরণ করার কথা থাকলেও হঠাৎ করে তার সফর বাদিল করা হয়। পরে কুড়িগ্রাম-২ আসনের সাবেক এমপি মো: জাফর আলী, জেলা প্রশাসক খান মো: নুরুল আমিন ও পুলিশ সুপার মো: তবারক উল্লাহ ২৫০টি পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল বিতরণ করেন। শেরপুরে পানি বৃদ্ধি অব্যাহতশেরপুর জেলা সংবাদদাতা জানান, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পানিবৃদ্ধির ফলে শেরপুর সদর উপজেলার চরাঞ্চলের চরপক্ষীমারী, চরমোচারিয়া, বেতমারী-ঘুঘুরাকান্দি, রৌহা, লছমনপুর, বলাইরচর ও চরশেরপুর ইউনিয়নের শতাধিক গ্রামে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।

প্রতিদিনই ভাঙছে ঘর-বাড়ি আর প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন গ্রাম। ফলে পানি বন্দি রয়েছে হাজার হাজার মানুষ। সোমবার বিকেলে শেরপুর সদর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নদী ভাঙন এলাকা থেকে ৪০টি পরিবারকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে বলে উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানাগেছে। এদিকে শেরপুর সদর উপজেলার ১০ হাজার একর জমির আমন দানের আবাদ পানির নীচে তলিয়ে গেছে। শত শত একর জমির সবজীর আবাদ এখন পানির নীচে।

এদিকে বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে মঙ্গলবার সকাল থেকে শেরপুর-জামালপুর সড়কের ডাইভারশনের ওপর দিয়ে প্রায় দের ফুট উচ্চতায় বন্যার পানি প্রবাহিত হওয়ায় ওই সড়কে ঝুঁকি নিয়ে ভারি যানবাহন চলাচল করলেও অটো সিএনজিসহ বিভিন্ন ধরনের হালকা যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে।বগুড়ায় বন্যার্তদের দুর্ভোগবগুড়া অফিস জানায়, বগুড়ায় বন্যাকবলিত এলাকায় চরম দুর্ভোগ চলছে। যমুনা ও বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

এবারের অতিবর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে যমুনা নদীতে পানি বৃদ্ধির কারণে আশপাশের বিভিন্ন নদ নদীতেও পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা দেখা দেয়। লোকালয়ে বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট ও পানি বাহিত রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাধের উপর কিছু পরিবার আশ্রয় গ্রহণ করলেও অধিকাংশ পরিবার নিরাপদ আশ্রয় না পেয়ে বন্যার পানির মধ্যে পরিবার পরিজন নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে।

বগুড়া পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস সূত্রে জানানো হয়েছে মঙ্গলবার বিকালে সারিয়াকান্দির যমুনা নদী পয়েন্টে ৭১ সেন্টিমিটার থেকে কমে বিপদসীমার ৬৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি স্থিতি থাকায় নতুন করে কোন এলাকা প্লাবিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় নি। তবে পানি বন্দি হয়ে জীবন যাপন করছে সারিয়াকান্দি উপজেলার নদীপাড়ের অনেক পরিবার।-ইনকিলাব
৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে