সোমবার, ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৩৪:৫৬

গরিবের সেই ‘ডাক্তার ভাই’ আর নেই

গরিবের সেই ‘ডাক্তার ভাই’ আর নেই

মুসলিম উদ্দিন আহমেদ : সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করাই ছিল যার ব্রত।  টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দিনরাত কাজ করে গেছেন ডাক্তার বেকার।  লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এমন মানুষ সাধারণত পাওয়া যায় না। গত মঙ্গলবার দুপুরে ৭৪ বছর বয়য়ে তিনি পরলোকগমন করেন। যবনিকাপাত ঘটে একটি আদর্শের পথপদর্শকের।

নিউজিল্যান্ডের তরুণ চিকিৎসক এড্রিক বেকার।  ’৭১ সালে কাজ করছিলেন ভিয়েতনামের একটি মেডিকেল টিমে।  তখন বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা, ভারতগামী শরণার্থীদের ছবি নিয়মিত ছাপা হতো।  এগুলো দেখে বাংলাদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন ডা. এড্রিক বেকার।

ডিসেম্বরে বিজয়ের খবর শুনে খুবই উল্লাসিত হন।  তখন থেকেই তার খুব ইচ্ছে একবার বাংলাদেশ ঘুরে যাবেন।  আসলেনও ১৯৭৯ সালে।  কিন্তু আর ফিরে যেতে পারলেন না।  বাংলাদেশের টানে এদেশের মানুষের টানে রয়ে গেলেন।  দীর্ঘদিন যাবত মধুপুর গড় এলাকায় অবস্থান করে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা করে গেছেন।

এড্রিক বেকারের জন্ম ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে। বাবা জন বেকার সরকারের পরিসংখ্যানবিদ ছিলেন।  মা বেট্রি বেকার ছিলেন শিক্ষক।  চারভাই দু’বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এড্রিক ডুনিডেন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন।  

পরে ওয়েলিংটনে ইন্টার্নি শেষে নিউজিল্যান্ড সরকারের সার্জিক্যাল টিমে যোগ দিয়ে চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্ত ভিয়েতনামে। সেখানে কাজ করেন ৭৫ সাল পর্যন্ত। মাঝে অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে পোস্টগ্রাজুয়েশন কোর্স করেন ট্রপিক্যাল মেডিসিন, গাইনী, শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে। ৭৬ সালে পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান।  কিন্তু কোথাও মন টেকেনি।  এরই মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে।

এক বছর পর সুস্থ হয়ে ৭৯ সালে চলে আসেন বাংলাদেশে।  বাংলাদেশে এসে এড্রিক বেকার প্রথমে মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দু’বছর ও পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে আটমাস কাজ করেন।  তার কোনো বড় হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছে ছিলো না।  ইচ্ছে ছিল প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার।  অন্যরকম কিছু করার। সে চিন্তা থেকেই চলে আসেন মধুপুর গড় এলাকায়।

তখন সাধারণ মানুষের মাঝে কাজ করতে গিয়ে মধুপুরের জলছত্র খ্রীষ্টান মিশনে এক বছরে বাংলা ভাষা শিখে নেন।  তারপর যোগ দেন গড় এলাকার থানারবাইদ গ্রামে ‘চার্চ অফ বাংলাদেশে’র একটি ক্লিনিকে।  সেই থেকে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিতে শুরু করেন ডা. বেকার।

৮৩ সালে দু’জন খণ্ডকালীন এবং তিনজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে বেকারের যাত্রা শুরু হয়।  দিনদিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা।  তখন পাশের গ্রাম কাইলাকুড়িতে ১৯৯৬ সালে উপকেন্দ্র খুলে চিকিৎসাসেবা দেয়া শুরু করেন। ২০০২ সালে একটি পূর্ণাাঙ্গ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হিসেবে কাইলাকুড়িতে কাজ শুরু হয়। এখন সেখানে শতাধিক গ্রামীণ যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষিত করে চলছে বেকারের স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম।

মধুপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় কাইলাকুড়ি গ্রামের অবস্থান।  এলাকার আদিবাসী-বাঙালি প্রায় সবাই দরিদ্র।  এরকম একটি প্রত্যন্ত এলাকায় চার একর জায়গার ওপর ডা. বেকারের স্বাস্থ্যকেন্দ্র।  ছোট ছোট মাটির ঘরে হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিভাগ, যক্ষা বিভাগ, মা ও শিশু বিভাগসহ আলাদা আলাদা বিভিন্ন বিভাগে চল্লিশজন রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে।  আগত রোগীদের সবাই দরিদ্র।

কাইলাকুড়ি গ্রামের প্রবীণ আদিবাসী নীরেন্দ্র দফো বলেন, প্রত্যন্ত এই এলাকায় রাস্তাাঘাট ছিলো না।  রোগবালাই হলে গ্রাম্য কবিরাজ বা হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে চিকিৎসা করানো হতো।  অনেকের কপালে তাও জুটতো না।  ডা. বেকার আসার পর এ এলাকার কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাননি।

জয়েনশাহী আদিবাসী উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি ইউজিন নকরেট বলেন, ডাক্তার বেকার ছিলেন মানবতাবাদী আদর্শ মানুষ।  যার চিন্তা চেতনা ছিল সাধারণ মানুষদের নিয়ে।  ভোগ বিলাস পরিহার করে পাহাড়িয়া এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের চিকিৎসাসেবা দিয়ে কাটিয়ে গেছেন সারাজীবন।  আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করি।

গরিব দুখী মানুষের সেবায় নিবেদতি থাকায় ‘ডাক্তার ভাই’ বলে পরিচিত হয়ে যান ডা. এড্রিক।  দীর্ঘ ৩৫ বছর টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা বিলিয়ে গেছেন তিনি।  মানবতার প্রতীক হয়ে উঠা ডা. বেকারকে ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।  সূত্র : চ্যানেল আই
২ সেপ্টেম্বর,২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এমআর/এসএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে