সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১২:৫১:২৬

তারেক নয়, নেতাদের পরামর্শেই দল গোছাবেন খালেদা জিয়া

তারেক নয়, নেতাদের পরামর্শেই দল গোছাবেন খালেদা জিয়া

সালমান তারেক শাকিল : লন্ডন সফরে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা ও তার অভিমত আমলে নিলেও দল গোছানোর ‘চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত’ নিতে ঢাকার ওপরেই আস্থা রাখছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। 'লন্ডনেই তারেক রহমানের সঙ্গে বসে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে'—এমন ধারণা কেউ-কেউ পোষণ করলেও বাস্তবে তা ঘটছে না বলে মনে করছেন বিএনপির বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতা। তাদের মতে, দলের মহাসচিব নির্বাচন, কাউন্সিল অনুষ্ঠান, ঢাকা মহানগর কমিটি ও স্থায়ী কমিটি গঠনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বর্তমান নীতি-নির্ধারকদের সঙ্গে বসেই সিদ্ধান্ত দেবেন বিএনপি চেয়ারপারসন। আগামী নির্বাচন ও নির্বাচনকেন্দ্রিক সরকারের আচরণ-মনোভাব, তারেক প্রসঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণ এবং তারেক রহমানের প্রতি সরকারের মনোভাবসহ দলের সিনিয়র নেতা ও বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীদের পরামর্শকে গুরুত্ব দিতেই এ পথে আসতে হবে খালেদা জিয়াকে। দলটির নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এ সব তথ্য জানা গেছে।

এদিকে, খালেদা জিয়ার গুলশান রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিবর্তন আসছে, এমনটি আলোচিত হলেও রাতারাতি কোনও বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছেন অন্তত চারজন স্থায়ী কমিটির সদস্য ও উপদেষ্টা। তারা মনে করেন, পরিবর্তন নয়, হয়তো নতুন কাউকে যুক্ত করতে পারেন খালেদা জিয়া।

সূত্রমতে, ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য লন্ডন সফরে গেছেন খালেদা জিয়া। ওই সফরের দৃশ্যত কারণ, বিএনপি প্রধানের চোখের চিকিৎসা হলেও তার দলের নেতাকর্মীদের ধারণা, বিদেশে বসেই দল গোছানোর সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি।  তবে অর্ধসত্য এই কারণটির সঙ্গে আরও কিছু রাজনৈতিক বিষয়ও সম্পৃক্ত। ওই বিষয়গুলোর মধ্যে তারেক রহমানের দেশে ফেরার বিষয়টি পর্যালোচনা, আইনি দিক খতিয়ে দেখা, পরবর্তী সময়ে বিএনপিতে তার ভূমিকা, পাশ্ববর্তী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সম্পর্ক ও সম্পর্কের ধরনসহ নানামুখী বিষয় রয়েছে।

বিএনপি চেয়ারপারসনের একজন গুরুত্বপূর্ণ উপদেষ্টা প্রতিবেদককে জানান, তারেক রহমান দলের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন—এটি যেমন ঠিক, তেমনি এই মুহূর্তে দলে তার ভূমিকার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার দেশের ফেরার পথ খোঁজা। ওই পথ যেভাবেই হোক বাস্তবায়ন করতে হবে। সরকার তারেক রহমানের দেশে আসার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। ফলে, যার দেশে ফেরার পথটি নিশ্চিত হয়নি এখনও, আমার মনে হয় না তিনি দলের সবদিক লন্ডনে বসেই ঠিক করবেন।

বিএনপির এই প্রভাবশালী নেতা বলেন, খালেদা জিয়া তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করবেন। তবে সিদ্ধান্ত গ্রহণে আমার ধারণা, তার মতকে প্রাধান্য দেওয়া হবে না। কারণ, হিসেবে এই উপদেষ্টা মনে করেন, পাশের দেশ তারেক রহমানের বিষয়ে এখনও পরিষ্কার নয়। পাশাপাশি দলীয় সিনিয়র নেতাদের মধ্যে তাকে নিয়ে এখনও পর্যালোচনা চলছে। ফলে, ম্যাডাম এটুকু বোঝেন যে, লন্ডন থেকে কমিটি করা হলে ঢাকায় সেটা টিকবে না।

এর আগে বিএনপির সুহৃদ হিসেবে পরিচিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, বিএনপিতে কেবল খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব থাকতে হবে। সিদ্ধান্ত দিতে হবে, একমাত্র তাকেই। তারেক রহমানের হস্তক্ষেপ কমিয়ে দিতে হবে। এক দলে দুই নেতার জায়গা হতে পারে না। এটা খালেদা জিয়াও এগ্রি করেছেন। তিনিও আমাকে বলেছেন যে, তিনিই দলে সিদ্ধান্ত দেবেন। তিনি গতিশীল ব্যক্তি। দলে ভিন্নমত, নানা মত থাকবে। তবে সিদ্ধান্ত একজনকে দিতে হবে।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির প্রবীণ সদস্য ব্যারিস্টার জমির উদ্দীন সরকার বলেন, ম্যাডাম লন্ডনে গেছেন চিকিৎসা করাতে, পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে। ওখান থেকে বসে কোনও সিদ্ধান্ত হবে না।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, আমি মনে করি না, লন্ডনে বিএনপির বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হবে। এখানে স্থায়ী কমিটি আছে, ভাইস-চেয়ারম্যানরা আছেন, উপদেষ্টারা আছেন। দলের যা কিছু সিদ্ধান্ত, তা দেশেই আলোচনা করে নেবেন ম্যাডাম। সাবেক এই সেনাপ্রধান জানান, তিনি বিষয়টিকে এভাবেই দেখতে চান, এভাবেই বুঝতে চান।

এদিকে লন্ডনে খালেদা জিয়ার সফরসঙ্গী না হলেও তার পাশাপাশি  দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতা সেখানে রয়েছেন। ওখানে দলের কর্মপন্থা নির্ধারণে তাদের ভূমিকা থাকবে, এমনটি আলোচনা হলেও মূলত বিএনপির নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রের দাবি ভিন্ন। সূত্রটির দাবি, যারা লন্ডনে আগে থেকে ছিলেন, তাদের বিষয়টি ভিন্ন। তবে যারা খালেদা জিয়ার আগে-পরে গেছেন, তাদের বেশিরভাগ গেছেন আগামীতে দলে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে। এমনকি দু-একজনের বিষয়ে স্বয়ং খালেদা জিয়া নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন, এমন নেতারা নেত্রীর কাছে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করার জন্য লন্ডনে গেছেন।

তবে লন্ডন থাকা একটি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়ার লন্ডন সফরে পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যবসা-বাণিজ্য, সমুদ্রের তেল-গ্যাস উত্তোলনসহ নানা বিষয়ে ওই দেশের সঙ্গে কথা হতে পারে। এ সব বিষয়ে নিশ্চয়ই ইতিবাচক আচরণ দেখাবেন খালেদা জিয়া। পাশাপাশি লন্ডন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করতে পারেন।

তবে জমির উদ্দীন সরকার বিষয়টি উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, লন্ডন বলেন, বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এদের এত ক্ষমতা নেই। ওদের পাওয়ার নেই। সব পাওয়ার সরকারের। ফলে, যা করার দেশে করতে হবে।

খানিকটা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, চেষ্টা অব্যাহত রাখাটা গুরুত্বপূর্ণ। ফল কী হবে, সেটা পরে দেখা যাবে।

সূত্রের দাবি, জঙ্গিবাদ প্রশ্নে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো বিএনপির কাছে তাদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে চাইবে। সেক্ষেত্রে জামায়াতকে নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও বিএনপি এ ক্ষেত্রে পেছাবে। দলটির অনেক নেতার ধারণা, জামায়াতকে ছাড়তে বলার কারণ সরকার। সরকারই চাইছে জামায়াতকে ছাড়িয়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে। সেক্ষেত্রে জমির উদ্দীন সরকারের অবস্থান, বিএনপি নিজে থেকে জামায়াতকে ছাড়বে না। তার মতে, জামায়াতকে ছাড়লে পুরো সুবিধা আওয়ামী লীগ নেবে।

এদিকে, বিএনপির অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটির নেতৃত্ব নির্ধারণ লন্ডনে হবে, এমন আলোচনাও অনেকটা অর্থহীন বলে মনে করে করছেন ছাত্রদলের প্রভাবশালী এক নেতা। ওই নেতার মতে, ছাত্রদলের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হয়ে ঘোষণার অপেক্ষায় ছিল। সরকার পরিকল্পিতভাবে সভাপতি রাজিব আহসানকে গ্রেফতার করায় তা থেমে গেছে। এছাড়া অন্য কমিটিগুলো ম্যাডামের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। লন্ডন থেকে সব নির্ধারণ হওয়ার বিষয়টা ঠিক নয়।

পরিবর্তন নয়, গুলশান কার্যালয়ে আসছে পরিবর্ধন
এদিকে, হঠাৎ করেই খালেদা জিয়ার গুলশান-২-এর রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিবর্তন হচ্ছে বলে শোনা গেলেও বিষয়টির সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। দলের সিনিয়র কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গুলশান কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর বিএনপিসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর ক্ষোভ দীর্ঘদিন ধরে থাকলেও খালেদা জিয়াকে জানানোর সাহস রাখেন না তারা। তবে এ নিয়ে স্বনামে মন্তব্য করতে কেউ রাজি হননি।

খালেদা জিয়ার একজন উপদেষ্টা জানান, ম্যাডাম ব্যক্তিগতভাবে প্রগলভপ্রিয় নন। তিনি একটু দূরে, ব্যবধান রেখে চলতে পছন্দ করেন। ফলে, খুব সহজেই তাকে রিচ করা সম্ভব নয়। এ কারণেই তার কর্মকর্তারা সুযোগ পেয়ে গেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে ইঙ্গিত করে এই উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক ব্যবহারিক দিক থেকে ম্যাডাম যদি উনার মতো সরাসরি খোঁজ-খবর নিতেন, নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলতেন, তাহলে আজ তার কার্যালয় ঘিরে এত প্রশ্ন উঠত না।

স্থায়ী কমিটির প্রবীণ এক সদস্য জানান, বঙ্গবন্ধু, জিয়াউর রহমান ছিলেন আড্ডাপ্রিয়, মজলিসি মেজাজের। তাদের কাছে যে কেউ যেতে পারতেন। এটা ম্যাডামের কাছে সম্ভব নয়। এটার ভালো দিক যতটা, খারাপ দিক তারও বেশি। এটাকে লিগ্যাল ডিসটেন্স বলতে পারেন। এতে ম্যাডামের মোহ, মোহময়তা বা মহান হওয়ার একটা ব্যাপার কাজ করে। তবে এই নেতার মতে, ভারসাম্য প্রয়োজন রয়েছে। ঘনঘন দেখা করা রাজনীতির কাজ। না করাটা ভালো নয়, আভিজাত্যও নয়। কিন্তু এই বিষয়টা অযাচিত অস্বস্থিবোধ এনে দিয়েছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সহসা কর্মকর্তাদের পরিবর্তন করার কোনও সুযোগ নেই। এতে ব্যক্তিগত প্রাইভেসি, নিরাপত্তা এসব নিয়ে খালেদা জিয়াকে চিন্তিত থাকতে হবে। হতে পারে, নতুন কাউকে যুক্ত করা হবে। তবে এখনই পরির্তনের কোনও সুযোগ নেই। সে সম্ভাবনাও নেই।-বাংলা ট্রিবিউন
এ প্রসঙ্গে  গুলশান কার্যালয়ের কোনও কর্মকর্তা মন্তব্য করতে রাজি হননি।
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে