সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৩:৪৬:১৮

মাঠ কোন্দলে আওয়ামী লীগ

মাঠ কোন্দলে আওয়ামী লীগ

বাদল নূর ও রফিকুল ইসলাম রনি : অভ্যন্তরীণ কোন্দল, আধিপত্য বিস্তার, সুযোগসন্ধানীদের তৎপরতাসহ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত তৃণমূল আওয়ামী লীগ। এমপি-মন্ত্রীদের পাশে এখন ত্যাগী নেতা-কর্মীরা ভিড়তে পারেন না। ভুঁইফোড়রাই নেতৃত্বের অগ্রভাগে। আদর্শ ও লক্ষ্য অভিন্ন, তবুও দুই মেরুতে অধিকাংশ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। জেলার শীর্ষ দুই নেতাকে ঘিরে কর্মীরাও বিভক্ত। কর্মসূচিও পালন করা হয় পৃথকভাবে। এ অবস্থায় ছয় মাস কি দেড় বছর আগে সম্মেলন সম্পন্ন হওয়া বেশ কিছু জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কমিটি গঠন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

আবার বর্তমান সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কাউন্সিলে ভোটযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অপরাধে জেলায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও দলীয় সভানেত্রীর কাছে পাঠানো কমিটির খসড়া তালিকায় নামও রাখা হয়নি এক নেতার। তৃণমূলে এমন হ-য-ব-র-ল অবস্থায় ১১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলীয় সভানেত্রী ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

দলীয় সূত্রমতে, এমপি-মন্ত্রীদের কারণে কমপক্ষে ২৫টি জেলার দলীয় রাজনীতিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকা ত্যাগী, সংগ্রামী ও কর্মীবান্ধব নেতারা এখন অনেকটাই কোণঠাসা। ত্যাগী নেতাদের কোনো মূল্যায়ন নেই দলে। নেতৃত্ব ও ক্ষমতা এখন হাইব্রিড নেতৃত্বের কব্জায়। উড়ে এসে জুড়ে বসা এসব নেতার দলে আবেদন না থাকলেও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কর্মীদের কাছে তারা বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। অনেকেই ব্যস্ত দলীয় পদ-পদবি ব্যবহার করে আখের গোছাতে। সাংগঠনিক কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অনেক জেলায় দিবসভিত্তিক ছাড়া কোনো কর্মসূচিই পালন করা হয় না। এমপিরা অধিকাংশ সময়ই ঢাকায় থাকেন। মাঝেমধ্যে এলাকায় গেলেও সরকারি কর্মসূচি শেষ করেই আবার ঢাকায় ফিরে আসেন।

তাদের অনুসারী হাইব্রিড নেতা ও আত্মীয়স্বজন এলাকার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে ক্ষোভের আগুনে পুড়ছে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। এতে বিভক্তিও দেখা দিচ্ছে দলে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক তৃণমূলকে শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেও জেলার নেতারা নিঃস্পৃহ। তারা নিজেদের সুবিধা আর ভোগবিলাসেই ব্যস্ত। দলীয় কর্মসূচির দিকে তাদের নজর নেই। অনৈক্য থাকায় জেলার রাজনীতির দৈন্যদশা। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এই প্রতিবেদককে বলেন, আওয়ামী লীগের মতো এত বড় একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা রয়েছে।

তিনি বলেন, কোন্দল নেই। সমন্বয় করে কমিটি গঠন করতে একটু দেরি হচ্ছে। দলীয় কোন্দল থাকার কারণেই তৃণমূল কর্মীরা মূল্যায়ন পাচ্ছেন বলেও মন্তব্য করে সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রতিবেদককে বলেন, রাজপথে বিরোধী দল নেই। দল ক্ষমতায় থাকলে কাজও কম থাকে। অভ্যন্তরীণ কোন্দল আছে বলেই তৃণমূল কর্মীরা মূল্যায়ন পান নেতাদের কাছে। কোন্দল না থাকলে জেলার শীর্ষ নেতারা একনায়কতন্ত্র কায়েম করতেন। কোন্দল থাকায় কোরাম ভারী করা বা নিজস্ব বলয় তৈরি যেভাবেই হোক কর্মীরা নেতাদের কাছে আসতে পারছেন।

নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় গত বছরের ২ ডিসেম্বর। সম্মেলনে সদর আসনের এমপি শফিকুল ইসলাম শিমুলের সঙ্গে ভোটযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শরিফুল ইসলাম রমজান। শুধু সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অপরাধে (!) তাকে বাদ দিয়েই জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি কেন্দ্রে জমা দেন জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক। এতে কেন্দ্রীয় নেতারা আপত্তি তুললে দলীয় সভানেত্রী শরিফুল ইসলাম রমজানকে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি পুনর্গঠনের নির্দেশ দেন। শিমুলের বিরুদ্ধে কাউন্সিলে ভুয়া ভোটার করার অভিযোগও রয়েছে।

স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, জেলার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর শিমুলের কারণে ত্যাগী ও মাঠের পরীক্ষিত নেতারা এখন কোণঠাসা। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের নিজ জেলা কুষ্টিয়ায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর সম্মেলন হয়। এতে সদর উদ্দিন খানকে সভাপতি ও আজগর আলীকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়। তবে ওই সম্মেলনে অজ্ঞাত কারণে একটি পক্ষ সম্মেলনে উপস্থিত না হয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে সম্মেলন শেষ না হতেই সংবাদ সম্মেলন ডেকে আনোয়ার আলীকে সভাপতি ও কুষ্টিয়া-৪ আসনের এমপি আবদুর রউফকে সাধারণ সম্পাদক করে কমিটি ঘোষণা করে। উভয় পক্ষই পৃথকভাবে দলের সভানেত্রীর কাছে কমিটি জমা দেয়।

এ ছাড়াও আনোয়ার গ্রুপ দলের আপিল বিভাগের কাছেও একটি অভিযোগ দাখিল করেছে বলেও সূত্র জানিয়েছেন। এ কারণে ১১ সেপ্টেম্বর জেলা কমিটি গঠন অনুমোদন দেননি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। এ জেলায় এখন বিভক্ত আওয়ামী লীগ। যশোরে রাজনীতির ফাঁকা মাঠে জেলা আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগ রয়েছে দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ সম্পাদক হওয়া সদর উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে। অন্য ভাগ রয়েছে যশোর-৩ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের সঙ্গে। গত সংসদ নির্বাচনের সময় থেকেই এ দুই অংশের মধ্যে বিভক্তি বাড়তে থাকে।

গত ঈদের পর শহরের কাজীপাড়ায় ঈদ পুনর্মিলনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান নিয়ে সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী এক সংসদ সদস্যের সমর্থকদের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সহিদুল ইসলাম মিলন বলেন, সাংগঠনিকভাবে যশোরে আমাদের অবস্থা এখন অনেক ভালো। দলের নেতা-কর্মীরা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণে।

দলের মধ্যে বিভাজন প্রসঙ্গে মিলন বলেন, একটু দূরত্ব আছে, অস্বীকার করব না। মাঝে দুটি কর্মসূচি আমরা একসঙ্গে করতে পারিনি। কিন্তু বাকি সব কর্মসূচিই সম্মিলিতভাবে হয়েছে। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছে গেল ২৬ ফেব্রুয়ারি। সেখানে সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ হারুন অর রশীদ ও সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশীদ সুজা এমপি। দুজনের মধ্যে চরম মতবিরোধ ও নিজের গ্রুপ ভারী করার কারণে জেলায় এখনো পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা সম্ভব হয়নি।

জানা গেছে, ওই জেলায় সভাপতি হতে চেয়েছিলেন বর্তমান সাধারণ সম্পাদক সুজা। সভাপতি হারুনকে ম্যানেজ করতে না পারায় সুজার সভাপতি হওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সম্মেলনের দিনই কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে হারুন গ্রুপের লোকজন মারধর করেন সুজার অনুসারীদের। জেলার দায়িত্ব নিলেও ২৬ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আজ পর্যন্ত মুখোমুখি হননি হারুন-সুজা।

সর্বশেষ ২৫ আগস্ট খুলনা মহানগর আয়োজিত এক স্মরণসভায় হারুন-সুজা উপস্থিত হলেও কথা হয়নি দুজনের মধ্যে। ফেব্রুয়ারিতে সাতক্ষীরা জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে সমঝোতার মাধ্যমে শুধু সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে দুজনের নাম ঘোষণা করা হয়। দুই সদস্যের এ কমিটির দুই নেতা আবার দুটি ধারার নেতৃত্ব দেন। জেলা আওয়ামী লীগের নিজস্ব কোনো কার্যালয়ও নেই। জেলা আওয়ামী লীগের একটি ধারার নেতৃত্বে আছেন জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক নজরুল ইসলাম। আরেকটি ধারার নেতৃত্বে আছেন বর্তমান সভাপতি মনসুর আহমেদ ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হক। তাদের সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন সাতক্ষীরা-২ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মীর মোস্তাক আহমেদ।

একাধিক ধারায় বিভক্ত নেতারা একেকজন একেক স্থানে বসেন। ফলে সাধারণ কর্মীদের একত্র হওয়ার কোনো ঠিকানা নেই। ঠাকুরগাঁও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি দবিরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সাদেক কোরাইশীর মধ্যে বিরোধ তুঙ্গে। দবিরুল ইসলাম জেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে হেন কাজ নেই যা করেন না। সঙ্গে আছেন পুত্র মাজহারুল ইসলাম সুজন। ওই জেলার সভাপতিও বলতে গেলে তিনি, সাধারণ সম্পাদকও। সাদেক কোরাইশীকে ছাড়াই সব সিদ্ধান্ত কার্যক্রম বাস্তবায়ন হয়। নামমাত্র পদে রয়েছেন কোরাইশী।

জানা গেছে, এসব কারণে সাদেক কোরাইশী জেলার রাজনীতিতে অনেকটাই কোণঠাসা। কুড়িগ্রামে ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব আর গ্রুপিংয়ে কাহিল আওয়ামী লীগ। এ অবস্থায় বিভিন্ন জাতীয় কর্মসূচিও পালিত হচ্ছে পৃথক পৃথক ব্যানারে। জেলা পরিষদ প্রশাসক মেজর জেনারেল (অব.) আ ম সা আমিন সব সময় ঢাকায় অবস্থানের কারণে আওয়ামী লীগের একাংশ এখন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আমান উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু গ্রুপে গা ভাসিয়েছে। সম্পাদকীয় পদবির অধিকাংশ নেতা আমান উদ্দিন মঞ্জু গ্রুপে যোগ দিয়ে দলীয় প্রতিটি কর্মসূচি পালন করছেন। এতে একাকিত্বে পড়েছেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক জাফর আলী।

জয়পুরহাট জেলা সভাপতি শামসুল আলম দুদু, সাধারণ সম্পাদক এস এম সোলায়মান আলী। তারা একজন আরেকজনকে বরদাস্ত করেন না। অভিযোগ রয়েছে, সোলায়মান আলী নিজের আধিপত্য বিস্তার করতেই সভাপতিকে চাপে রাখার চেষ্টা করেন।

জানা গেছে, সাধারণ সম্পাদক সোলায়মান আলী বিএনপি-জামায়াতের লোকজনকে দলে যোগদান করাচ্ছেন সভাপতিকে না জানিয়েই। আর তা মেনে নিতে পারছেন না জেলার সভাপতি দুদু। আগস্টের শেষের দিকে দলীয় কার্যালয়ে বসে অন্য নেতা-কর্মীদের কাছে এ ক্ষোভের কথা জানান দুদু। তা ছাড়া সভাপতি হলেন এমপি, সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন জেলা প্রশাসক। দুজনের ভিতর ক্ষমতার টানাপড়েনও রয়েছে। রাজনৈতিক সখ্য না থাকায় ওই জেলায় প্রকৃতপক্ষে সাংগঠনিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ও ভিত্তি দুর্বল বলে স্থানীয় সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে।

নেত্রকোনার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মতিয়ার রহমান খান আর সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান খসরুর মধ্যে চরম বিরোধ। মাস দুয়েক আগে কলমাকান্দা উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এ বিরোধ প্রকাশ্যে আসে। ওই সম্মেলনে আশরাফ আলী খান খসরুকে মতিয়ারের লোকজন চরম অপমান করেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। ওই দিন কলমাকান্দা উপজেলা সম্মেলনে খসরু ভোটের মধ্য দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচনের দাবি করে সভাপতি মতিয়ারের চক্ষুশূল হন। এর আগেও দুজনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে টানাপড়েন দেখা দেয়। পরে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুজন দুই মেরুর হয়ে পড়েন। জেলার সাবেক সভাপতি শামসুজ্জোহা বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে জনগণের সেবা করার জন্য রাজনীতি করেছি। এখন তা প্রয়োজন হয় না।-বিডিপ্রতিদিন
২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে