সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৫:১৫:১৪

মা

মা

পাঠকই লেখক ডেস্ক : না অনুকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। তার চলে যাওয়ার পেচনে আমার ইচ্ছা অনিচ্ছা দুটোই ছিল। আমার অভি আমার কাছেই থেকে গেল। জানিনা এটা পিতৃভক্তি কিনা।

আমি আশরাফ। একটা কোম্পানীর এম.ডি। কোন এক ফাগুনে ধনীর দুলালী অনুকে ভালোবেসে বিয়ে করি। ভালোই কেটেছিল দিনগুলো। আমি দুই সন্তানের বাবা হলাম। নতুন অনুভূতি নিয়ে সুখের ভেলায় ভাসতাম দুজনই। দু কুলে শুধু বেচে আছেন আমার মা। মাকে আমি অনেক ভালবাসি। কিছুদিন হল মা আমার চলাফেরা করতে পারছেন না। নাতি-নাতনীদের আমাদের চাইতে বেশী আগলে রাখতেন তিনি। এখন আর পারছেন না।

একদিন অফিস থেকে এসে দেখি মা মল মূত্রে বিছানা ভরিয়ে ফেলেছেন। অনু অভি আর ছায়াকে নিয়ে খেলছে। রাগের মাথায় অনুর গায়ে হাত তুললাম। অভিমান করে বাপের বাড়ী চলে গেল। ওদের সাথে করে নিয় যেতে চাইল। অভির বয়স ছিল সাত বছর। সে গেলনা। ছায়া এখনো দুধ খায় তাই ওকে নিয়েই চলে গেল। বাধা দিলাম না। কারন আজকাল অনু আমার মার প্রতি অবহেলার মাত্রাটা বাড়িয়েই চলছে। মাকে বুড়ি ছাড়া কথা বলতোনা। অনেক বলেও তার মুখ থেকে শব্দটা সরাতে পারছিনা। মা খেয়েছেন না খেয়েছেন খোজ নিতোনা।

আমাকে অফিসেই বেশি সময় কাটাতে হতো। একটা কাজের মেয়ে রাখলাম রান্না করার জন্য। কোন একদিন বাসায় ফিরে দেখি আমার অভিটার সমস্ত শরীরে ময়লা। দাদুকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। মা আমাকে কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেলন - ""বাবা তোর বউয়ের কাজটা আজ আমার দাদুভাইটা করেছে রে। আমাকে পরিষ্কার করেছে সেই। কিন্তু তাকে পরিষ্কার করার তো কেউ নাই। বউরে নিয়া আয়। আমার সেবা না করুক নিজের ছেলেটাকে পরিষ্কার করতে পারবে""।

(বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছিল। কারন অনুকে অনেক বুঝিয়েও ফিরিয়ে আনতে পারিনি। তার শেষ কথাটা ছিল হয় আমি থাকবো, নয়তো বুড়ি। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিলাম। ফোনটা রেখে দিলাম, আর ভাবলাম আমৃত্যু তার সাথে যোগাযোগ রাখবো না)

অভি আর মাকে আমি জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলাম। মাও কাঁদছেন আর অভি আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। অভি আমাকে বলল - ""বাবা কেঁদোনা। যতদিন দাদী সুস্থ না হয় আমি স্কুলে ভর্তি হবোনা""। আমার মুখ থেকে কোন কথা বেরলো না।

একদিন বাসায় ফিরে দেখি অভি কাঁদছে। অভি কেঁদে কেঁদে বলছে বাবা দাদী আজ খাট থেকে পড়ে গেছে, আমি সামলাতে পারিনি। মাকে দেখলাম বিছানায় কাতরাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলাম। এক্স রে রিপোর্ট এলো মার মাজার হাড় ভেঙ্গে গেছে। ডাক্তার বলেছেন মায়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে প্রতিটা মুহুর্ত। যতদিন বাঁচে যাতে কষ্ট না পান। সেদিন রাতে ঘুম আসছিল না। হাজারো ভাবনা মনের মধ্য উকি দিচ্ছে। মনে পড়ছে ছোটবেলার কথাগুলো।

মা আমার বড়ই অভাগা ছিলেন। লাল শাড়ীতে জড়ানোর পাঁচ বছর যেতে না যেতেই বাবা চলে যান ওপারে। তখন আমার বয়স তিন বছর। সরকারি চাকুরীজীবী ছিলেন বলে পেনশনের টাকা দিয়েই কোনভাবে চলে যেত। আমাকে কেউ অবহেলা করবে এই ভয়ে মা আমার আর নতুন করে সংসার সাজাননি। আমিই যেন মায়ের পৃথিবীর সমস্ত সুখ।

সেবার স্কুল থেকে পিকনিকে যেতে চেয়েছিলাম মায়ের হাতে টাকা ছিলনা। নাকফুলটা বিক্রি করে টাকা দিয়েছিল। তখন টাকা পেয়েই খুশি ছিলাম। অতসত বুঝার বয়স হয়নি। ছোটবেলায় মা আমাকে আলী বাবা চল্লিশ চোরের গল্প শুনিয়ে শুনিয়ে ভাত খাওয়াত। প্রতিবেলায় ডাল ভাত খেতে চাইতাম না। মা বলতেন জানিস বাবা আগেকার দিনে রাজা বাদশারা ডালভাত খেত। তুইতো রাজা।

তখন আর খারাপ লাগত না। মনে আছে বাবা মারা যাবার পর প্রতিটি ঈদেই নতুন জামা পেতাম। বাবার শুন্যতাটা অনুভব হতনা। অথচ মাকে কখনো দেখিনি নতুন কাপড় পড়ে ঈদ করতে। প্রতিটা মূহুর্ত মা আমাকে আগলে রাখতেন। একবার আমি টাইফয়েড জ্বরে ভুগছিলাম। মা একটানা ১২ দিন চোখের পাতা এক করেননি। বাথরুমে যাওয়ার শক্তি ছিলনা। অথচ কখনোই আমি নোংরা থাকতাম না। মা অকপটে সমস্ত ময়লা নিজ হাতে পরিষ্কার করে ফেলতেন।

আজ আমি এত্তবড় অফিসার যে বিশাল আলিশানে মাকে রাখি, অথচ মায়ের মনের আলিশানটা অতৃপ্ত। না আমার মাকে হারাতে পারবো না। কালই চাকরিটা ছেড়ে দেব।

আশরাফ চাকরিটা ছেড়ে দিল। প্রতিটি মুহুর্ত মায়ের শিহরে কাটায়। আর অভি বাবাকে সাহায্য করে। অভিকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করিয়ে দিলো আশরাফ।

অনু তার বাবা বাড়ী এসে মেয়েকে নিয়ে সুখেই ছিল। কিছুদিন ধরে মেয়েটা অসুস্থ। ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করছে না। মাঝরাতে যখন অঘোর ঘুমে চোখ ফেটে যায় তখনও ঘুমোতে পারছেনা অনু। রাতে প্রস্রাবে মেয়েটার ঠান্ডা লেগে য়ায়। একদিনতো মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকতেই দিলনা। সমস্ত কাপড়ের আছলে মেয়ের পায়খানা লেগে আছে। সেদিন অপমানবোধটা মনে ছিলনা। ছিল শুধু মেয়েকে বাঁচাতে হবে এই আকুতি। বিধাতার কাছে হাজারো প্রার্থনা মেয়েটাকে সুস্থ করে দাও হে খোদা। আজ তার মেয়েটা সুস্থ।

একদিন আনমনে বসে আছে অনু। গত এক সপ্তাহে তাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। সবই ভুলে গেছে মেয়ের সুস্থতা দেখে। হঠাৎ পুরনো ডায়েরিটা নজরে পড়ল। হাতে নিয়ে পাতা উল্টাচ্ছিল। তার মধ্যে আশরাফের একটা ছবি ছিল মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। অনুর আজ অনেক বেশি মনে পড়ছে সেই বুড়ির কথা। যার একটুখানি সেবার ভয়ে স্বার্থন্বেষি হয়ে এতোসব ভালোবাসা ছেড়ে চলে আসে সে।

আজ তার কাছে নিজেকে অপরাধী লাগছে। এই মাও তো আশরাফকে এতটাই কষ্ট করে আজ এতবড় করেছেন। জীবনে কোনদিনতো প্রকাশ করেননি। সাতটা দিন যেন সাতটা যুগ হয়ে কাটিয়েছে সে। তবে আশরাফের মা কতগুলো যুগের আত্বদানে ওকে এত বড় করেছেন। এতসব অনুভূতি অভিকে নিয়ে হয়নি। কারন তখন পাশে ছিল আশরাফ। আজ তার সমস্ত ভুল ভেঙ্গেচ্ছে। নিজেকে শোধরে নেবেন অনু। যতক্ষন পর্যন্ত ক্ষমা না করেন মায়ের পা ছাড়বেননা অনু। সিদ্ধান্ত নিল আজই মেয়েকে নিয়ে ফিরে যাবে স্বামি শ্বাশুড়ির কাছে।

আশরাফের কান্নার স্রোতে সমস্ত হাসপাতাল কম্পমান। তার মা আর দুনিয়াতে নেই। ডাক্তার বলেছেন রুগির সেবার অভাব ছিল। পর্যাপ্ত সেবা পেলে হয়তো এই করুন মৃত্যুটা হতোনা। একজন ছেলে আপনি যা করেছেন আপনাকে নিয়ে গর্ব করার মত। কিন্তু আশরাফ সাহেব একজন পুরুষ কখনো একজন নারীর পরিপূর্ন সেবা দিতে পারেনা। সমস্ত কথাই শুনলো অনু। অনু বুঝল তার অপরাধটা ক্ষমার অযোগ্য। আশরাফের সামনে যাওয়ার মুখ তার নেই। মেয়েকে নিয়েই সে ফিরে এলো।
বাবার অঝোর ধারায় কান্না দেখে বাবাকে জড়িয়ে ধরে অভিও কাঁদল বেশ। বাবা অভিকে তার মোবাইলের ইনবক্সটা দেখাল। অভি পড়তে লাগল।

"আমি জানি শুধু তুমি নয়, পৃথিবীর কোন মানুষই আমাকে ক্ষমা করবে না। ছায়াকে বাসায় রেখে গেলাম আর আমি চললাম দূর বহুদূর। রেলে কাটা পড়া কোন লাশের সন্ধান পেলে একটু খোজ নিও।"

লেখক : মোস্তফা কামাল রিয়াদ
বি:দ্র:  সম্পাদক দায়ী নয়
২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসবি/বিএসএস 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে