রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:১১:৩০

কোন্দলে জর্জরিত ছাত্রদল, এক বছরেও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি

কোন্দলে জর্জরিত ছাত্রদল, এক বছরেও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি

মাহমুদুল হাসান : অক্টোবরে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটির মেয়াদ এক বছর পূর্ণ হবে। ২০১৪ সালের ১৪ অক্টোবর গঠন করা কমিটি এক বছরেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি দিতে পারেনি।

দলের কর্মীদের অভিযোগ, গ্রুপিং আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ছেন ছাত্র সংগঠনটির শীর্ষ নেতৃত্ব। ঢাকা মহানগর কমিটি গঠন নিয়েও চলছে নানা ষড়যন্ত্র।

এদিকে চলমান আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে না পারায় হতাশ সংগঠনটির মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা। নতুন কমিটি ঘোষণার পরও গতি পায়নি সংগঠনটির কার্যক্রম। বিবৃতি ছাড়া বড় কোনো কর্মসূচি দিয়ে মাঠে নামতে পারেনি নেতাকর্মীরা। এমনকি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মাজারে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেও পারেনি বর্তমান কমিটির নেতারা। বর্তমানে ছাত্রদল সভাপতি রাজীব আহসান ২০ জুলাই থেকে কারাগারে আছেন।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে ঈদের পর কমিটি পুনর্গঠন করে স্বরূপে ফিরতে চায় ছাত্রদল। ছাত্রদল নেতাদের দাবি, খালেদা জিয়ার দিকনির্দেশনায় কমিটি পুনর্গঠন করা হবে। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার কাছে কমিটির পুনর্গঠন নিয়ে খসড়া তালিকা দেওয়া হয়েছে। খালেদা জিয়া লন্ডনে (মঙ্গলবার রাতে দুই সপ্তাহের সফরে ঢাকা ছাড়েন খালেদা জিয়া) বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলাপ করে তা চূড়ান্ত করবেন। ঈদের পর খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর কমিটি ঘোষণা করা হবে।

এ বিষয়ে ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ প্রতিবেদককে বলেন, ছাত্রদল এত বড় একটি সংগঠন। টুকটাক গ্রুপিং থাকতে পারে। এ সব মাথায় রেখেই আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।

আসাদুজ্জামান আসাদ আরও বলেন, বর্তমান কমিটি ঘোষণার পর বিদ্রোহ শুরু হয়। ফলে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। তা ছাড়া শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে রয়েছে একাধিক মামলা। ফলে আমরা একসঙ্গে বসতে পারিনি। এর মধ্যেই এক বছর হতে চলছে।

তিনি আরও বলেন, ঈদের পর কমিটি পূর্ণাঙ্গ করা হবে। সুপার ইউনিট কমিটিগুলোও ম্যাডামের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। তিনি লন্ডনে দলের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করবেন।

ছাত্রদলের সহ-সভাপতি ইশতিয়াক আহমেদ নাসির ছাত্রদলের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কথা স্বীকার করেন। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকা মহানগর কমিটি হচ্ছে সুপার ইউনিট। নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণেই ১০ বছর ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি পুনর্গঠন করা যাচ্ছে না।

ছাত্রদলে বড় ধরনের কোনো কোন্দল নেই উল্লেখ করে ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, যা আছে তা ব্যক্তিগত পর্যায়ে, এটা বড় করে দেখার কিছু নেই।

ইশতিয়াক আহমেদ নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কথা অস্বীকার করলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে জিয়ার সমাধিতে ফুল দেয়াকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের এক নেতার অনুসারী আরেক নেতার অনুসারীকে মারধর করে। ছাত্রদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুনুর রশীদ মামুনের অনুসারী ধানমণ্ডি থানা ছাত্রদল নেতা গাজী মনির মারধর করেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম-সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের অনুসারী রাকিবুল ইসলাম রাশেদকে।

এরপর গত ৩ সেপ্টেম্বর কাকরাইলের ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের মিলনায়তনে বিএনপির জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের অষ্টম কারামুক্তি দিবসের অনুষ্ঠানে ছাত্রদলের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। অনুষ্ঠান শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মামুন ও আসাদের সমর্থকরা হাতাহাতি-সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। মামুনের সামনে থেকে ধরে নিয়ে গাজী মনিরকে মারধর করা হয়। আসাদকেও লাঞ্ছিত করা হয়।

এর আগে গত ৯ মে বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টুর জন্য আয়োজিত দোয়া মাহফিলে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের মধ্যে মারামারি হয়।

ছাত্রদলের সাধারণ কর্মীদের দাবি, নিজেদের মধ্যে গ্রুপিংয়ের কারণে দিন দিন ঐক্য হারাচ্ছে ছাত্রদল। তৈরি হচ্ছে আস্থাহীনতা। বাড়ছে মানসিক দূরত্ব। এক বছরেও ‘সুপার ফাইভ’ নেতারা এক টেবিলে বসতে পারেননি। এটা নেতৃত্বের অপরিপক্বতা। এ ছাড়া বর্তমান কমিটির নেতারা কোনো সাধারণ সভা করতে পারেনি। এমনকি একটি বৈঠকেও বসতে পারেননি তারা। এভাবে ছাত্রদল চলতে পারে না। শুধু পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতেই প্রায় এক বছর পার হয়ে গেছে। এখনো পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি কেন্দ্রীয় কমিটি, ২০১ সদস্যের মধ্যে ১৫৩ জনের নাম প্রকাশ করা হয়। এ ছাড়া ঢাকা মহানগরসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কমিটিও দিতে পারেনি তারা। থেমে আছে অন্যান্য ইউনিট কমিটির পুনর্গঠনও।

ছাত্রদলের এক শীর্ষ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিবেদককে বলেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন সারাদেশে মারামারি কাটাকাটিতে ব্যস্ত। অথচ তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে কাউন্সিলের মাধ্যমে কমিটি গঠন করতে পারে। বৃহৎ সংগঠন হয়েও এক বছরে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করতে পারেনি ছাত্রদল। এতে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে ছাত্রদলের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হুমকির মুখে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে রাজপথের আন্দোলনে কর্মী খুঁজে পাওয়া যাবে না।

গত জুলাই মাসে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়েছে। ছাত্রলীগ সভাপতি পদে সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক পদে জাকির হোসেন নির্বাচিত হয়েছেন।

গত বছরের ১৪ অক্টোবর রাজিব আহসানকে সভাপতি ও মো. আকরামুল হাসানকে সাধারণ সম্পাদক করে ছাত্রদলের (আংশিক) কমিটি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু কমিটি ঘোষণার পর থেকেই তা প্রত্যাখ্যান করে বিক্ষোভ জানায় কিছু ‘বিদ্রোহী’ নেতাকর্মী। একই সঙ্গে তারা বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী ও সহ-ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুকে সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবিও জানায়।

বিদ্রোহের এক পর্যায়ে নতুন কমিটির সঙ্গে সংঘর্ষ, কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভাংচুর, এ্যানী-টুকুর ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে। এর জের ধরে একপর্যায়ে সংগঠনটির সাত নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ও তিন নেতাকে বহিষ্কার করা হয়।

তবে চলতি বছরের শুরুতেই বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলনকে সামনে রেখে সংগঠনের তিন নেতার বিরুদ্ধে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে। তবে সাময়িকভাবে প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের অবসান হলেও অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে নেতারা। যা মাঝে মধ্যে প্রকাশ্য রূপও নেয়।

এদিকে ঢাকা মহানগর ছাত্রদল কমিটি গঠন নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলছে এমন অভিযোগ রয়েছে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও উত্তর ছাত্রদল কমিটি চার ভাগ করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি শরিফ উদ্দিন জুয়েল এই প্রতিবেদককে বলেন, সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য শীর্ষ নেতারা যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তবে একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। আর তা হল, কমিটি ভাগ করার মাধ্যমে নেতৃত্বের সংকট যেন তৈরি না হয়।

তবে এই মুহূর্তে ঢাকা মহানগর কমিটি চার ভাগ করার মত অবস্থায় নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি করতে হলে একটু সময় নিতে হবে। হঠাৎ করে ঢাকা মহানগর চার ভাগ করা হলে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নেতৃত্ব উঠে আসবে। তাই ভবিষৎ আন্দোলন মাথায় রেখে কমিটি গঠন করা জরুরি।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাজমুল হাসান প্রতিবেদককে বলেন, মহানগর কমিটি চার ভাগের কথা শুনেছি। তবে এর কার্যকারিতা কতটুকু তা জানা নেই।

তিনি আরও বলেন, ছাত্রদলের ঐক্য ধরে রাখতে মেধাবী ও ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

উল্লেখ্য, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্রদল প্রতিষ্ঠা করেন। ছাত্রদলের প্রথম আহ্বায়ক কাজী আসাদ।-দ্য রিপোর্ট
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে