রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৪:৫০:৪২

হালাল পণ্যের ঝুঁকিতে দেশ

হালাল পণ্যের ঝুঁকিতে দেশ

শাহ আলম খান : বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হালাল পণ্যের ঝুঁকি বাড়ছে। উদার বাণিজ্যিকীকরণই এ ঝুঁকির অন্যতম কারণ। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত জিলেটিন এই সংশয় তৈরি করেছে। শূকর, ঘোড়া, গরু, মোরগি, মাছসহ বিভিন্ন প্রাণীর চামড়া, চর্বি এবং হাড় থেকে তৈরি হয় জিলেটিন। পুষ্টিকর এ কাঁচামাল দিয়ে তৈরি খাবার, ওষুধ এবং প্রসাধনী সহজেই হাতের কাছে পাওয়ায় কিনছে ভোক্তারা। চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এসব পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের পাশাপাশি আমদানিও হচ্ছে। চাহিদা পূরণের তাগিদে বদলে যাচ্ছে ভোক্তার ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিও। ফলে নিজের অজান্তেই সবাই অতিক্রম করছে হালাল হারামের সীমানা।

কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞদের মতে, জিলেটিন হচ্ছে বর্ণহীন, স্বচ্ছ, গন্ধহীন এক ধরনের প্রোটিন। এটি সহজেই পানিতে মিশে যায়। ঘনত্বের ওপর ভিত্তি করে এটা দিয়ে ‘জেল’ তৈরি করা হয়। এই জেল এখন শিল্পোৎপাদনের অন্যতম কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্বের বেশিরভাগ জিলেটিনই শূকর বা আল্লাহর নামে জবাই করা হয়নি এমন প্রাণী থেকে আসছে। বিশ্ব চাহিদার ৪৪ শতাংশ জিলেটিন শূকরের চামড়া থেকে তৈরি হয়। ২৮ শতাংশ তৈরি হয় গরুর চামড়া থেকে। মাত্র ১ শতাংশ মাছ, মোরগি বা অন্যান্য ঘর্ম নিরপেক্ষ প্রাণীজ উৎস্য থেকে। এর বাইরে ২৭ জিলেটিন তৈরি হয় পশুর হাড়গোড় থেকে। এখানে পশু বলতে শূকর ও গরুকেই মূলত বোঝানো হয়।

সংশ্লিষ্টরা জানান, যেসব কারখানায় জিলেটিন তৈরি করে তারা মূলত সব ধরনের পশুর হাড় থেকেই জিলেটিন উৎপাদন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব প্রাণীজ হারগোড় এক সঙ্গে প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়। ফলে গরুর হাড়ও শূকরের হাড়ের সঙ্গে মিশে যায়।

আরও জানা যায়, জিলেটিনের ৮০-৯০ শতাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে অমুসলিম দেশের। এসব দেশে বেশিরভাগ পশুই আল্লাহর নামে জবাই করা হয় না। এর মধ্যে ৩৯ শতাংশ ব্যবহৃত হয় পশ্চিম ইউরোপে, ২ শতাংশ পূর্ব ইউরোপে, ২০ শতাংশ উত্তর আমেরিকায়, ১৭ শতাংশ ল্যাটিন আমেরিকায় এবং ২২ শতাংশ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে।

বিশ্বের মুসলিম দেশগুলো হালাল পশুর চামড়া ও হাড় থেকে জিলেটিন তৈরি করে। কিন্ত এর পরিমাণ বিশ্বচাহিদার ১০ থেকে ২০ ভাগ মাত্র। পশ্চিমা বিশ্বে পণ্যটি তৈরির জন্য যে পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করছে তা আল্লাহর নামে জবাই করা হয় না। ফলে এভাবে তৈরি কাঁচামালটি মুসলমানদের কাছে হারাম হয়ে যাচ্ছে। একই ভাবে হিন্দুদের জন্য নিষিদ্ধ গরুর চামড়া ও হাড় দিয়ে তৈরি কাঁচামালটি নিষিদ্ধ, রোমানীয়দের জন্য ঘোড়ার বর্জ্যরে তৈরি কাঁচামাল নিষিদ্ধ। একই ভাবে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে একেক ধরনের পশুর মাংস বা এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খাওয়া ও ব্যবহারের বিষয়ে বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু কাঁচামাল জিলেটিন ব্যবহার করে উৎপাদিত পণ্য ব্যবহার করছে সব দেশের মানুষই। এদের অধিকাংশই জানেই না, যা খাচ্ছে ও ব্যবহার করছে তা তাদের ধর্মের স্বীকৃত পশুর বর্জ্য থেকে উৎপন্ন কাঁচমাল দিয়ে তৈরি হয়েছে কিনা।

ইসলামী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুসিলমদের জন্য শূকর, শূকরের চর্বি কিংবা এ জাতীয় উপাদানে তৈরি খাদ্য হারাম। আবার হিন্দুদের বেলায় গরু। দেশ ভেদে রোমানীয়দের কাছে ঘোড়া খাওয়া নিষিদ্ধ। ফলে মুসলমান, হিন্দু ও ইহুদি প্রায় সব ধর্মাবলম্বীদের কাছে ৯৯ শতাংশ ‘জিলেটিন’ উপকরণ হারাম বা নিষিদ্ধ। অথচ পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থে খাদ্যপণ্য ভক্ষণ বিষয়ে বলা হয়েছে ‘হালালান তাইয়্যেবা’। অর্থাৎ ‘খাদ্য হতে হবে পবিত্র ও বিশুদ্ধ।

যেসব পণ্যে জিলেটিন ব্যবহার হয় : জেলি জাতীয় খাদ্য, ফ্রুটজেল, ক্রিমচিজ, গামক্যান্ডি, ফালুদা, চাইনিজ স্যুপ, থিকেনার বা পাচকারী উপাদান হিসেবে কোনো কোনো সস, অ্যাসপিক’-এ জিলেটিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া ইয়োগার্ট, আইসক্রিম, কিছু এনার্জি ড্রিংকসে বিশেষত বিটা ক্যারোটিন সমৃদ্ধ হলুদ রঙের ড্রিংকসে, ফ্রুট জুস এবং মোরব্বা তৈরির কিছু ক্ষেত্রে জিলেটিন ব্যবহৃত হয়। প্রসাধনীর মধ্যে হেয়ারজেল, বডি লোশন, ফেস মাস্ক, সাবান, মেকাপের কিছু উপাদান লিপিস্টিক, শ্যাম্পু, হেয়ার কন্ডিশনা তৈরিতে জিলেটিন ব্যবহৃত হচ্ছে।

এছাড়া ক্যাপসুল, ক্যান্ডি, ভিটামিন ক্যাপসুল, কড লিভার অয়েল, ডেইরি ফুড, পোস্ট পার্মিং, ট্রিটমেন্টে নখের প্রসাধনীতে জিলেটিন বা হাইড্রোনাইজড কোলাজেন থাকে। ওষুধ শিল্পের মধ্যে জিলেটিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ক্যাপসুলের খোল বা শেল তৈরিতে। এছাড়াও সাপোজিটরি, ট্যাবলেট ফিল্মিং বা আবরণ হিসেবে সাসটেইন রিলিজড ওষুধ এনক্যাপসুলেশেনে বাইন্ডার হিসেবে বিটা ক্যারোটিনকে জলীয় দ্রবণের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। হালাল সার্টিফিকেট দেয়ার সঙ্গে জড়িত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একাধিক সূত্রে এসব পণ্যের নাম পাওয়া গেছে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) হিসাবে সারা বিশ্বে প্রায় ১৭ লাখ ট্রিলিয়ন ডলারের আমদানি বাণিজ্য হয়। আর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ বলছে, সেখানে হালাল পণ্যের বাণিজ্য মাত্র প্রায় ৯০০ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। অর্থাৎ বিশ্বজুড়েই হালাল পণ্যের ঝুঁকি রয়েছে। আর বিশ্বায়নের যুগে মুক্তবাজার অর্থনীতির কল্যাণে সেই ঝুঁকি বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেল সূত্রমতে, সার্বিকভাবে দেশে প্রায় ৮ হাজারের অধিক এইচএস কোডের আওতায় আমদানি-রফতানি বাণিজ্য হয়। ইসলামিক ফাউন্ডেশন সূত্রমতে, আমদানি বাণিজ্যে খাদ্য, ওষুধ কিংবা প্রসাধনী কোনো পণ্যেই হালালের গ্যারান্টি মিলছে না। দেশে উৎপাদন হয় এমন পণ্যেরও শতভাগ নিশ্চয়তা নেই। অথচ দেশের ১৬ কোটি মানুষের সিংহভাগই এর নিয়মিত ভোক্তা বা ক্রেতা।

এ ধরনের নিষিদ্ধ পণ্য বাংলাদেশে প্রবেশে কড়াকড়ি আরোপের জন্য আছে আমদানি নীতিমালা
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন প্রতিবেদেককে বলেন, আমদানি নীতিমালায় সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। এই নীতিমালায় আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের ১০টি ফুডনোট রয়েছে। এর মধ্যে ৮ নম্বর শর্তে বলা আছে ‘জীবিত শূকর এবং শূকরজাত সব ধরনের পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ।’ আমাদের আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রক কার্যালয় সূচারুভাবে এসব বিষয় দেখভাল করে আসছে।

সূত্র জানায়, ‘জিলেটিন’ উৎপাদনের অন্যতম উপকরণ হওয়ায় সরকারের দায়িত্বশীল বিভাগগুলোর কর্মকাণ্ডও হালাল-হারামের বিষয়টি খুব একটা কার্যকরী উপায় বের করতে পারছেন না। আবার ব্যবসায়ীরাও তার বাণিজ্য ও মুনাফাকেই বড় করে দেখছেন। ব্যবসায় তারা ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি সেভাবে বিবেচনায় আনছেন না। তাই এসব পণ্যের আমদানি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে পণ্যের হালাল ‘লোগো’ ও কোম্পানির হালাল সার্টিফিকেট’ অনুসন্ধানের তাগিদ অনুভব করছেন না। একইভাবে দেশেও এর সবকটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানে ব্যাচ ধরে ধরে হারাম উপাদানের অস্তিত্ব আছে কিনা সেটি পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবম ফারুক এই প্রতিবেদককে একটি উদাহরণ টেনে বলেন, ধরুন অ্যালকোহল এক কথায় হারাম। কিন্তু এটা যদি ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় এবং সেটি জীবন রক্ষাকারী হয় তাহলে সেটিকে হারাম বলা যৌক্তিক নয়। হালাল-হারামের বিষয়টি আসলে আপেক্ষিক। ধর্মভেদেও এর ভিন্নতা আছে। এক ধর্মের জন্য হালাল হলে সেটি অন্য ধর্মের জন্য হারাম হতে পারে। কিন্তু মনে রাখতে হবে প্রয়োজনটাকে অস্বীকার করা যাবে না। তাই যুগের সঙ্গে তালমিলিয়ে না চলতে পারলে বিপদ।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খাদ্য যতটা সম্ভব হালাল রাখা উৎপাদকের কর্তব্য। এক্ষেত্রে অনেকের কাছে জিলেটিন আতংকের কারণ হলেও আমি বলব এটি নির্ভর করছে এই উপকরণটির ব্যবহারের ওপর। সেটি দেখভালের জন্য দরকার নিয়ন্ত্রক সংস্থার। এ জন্য দেশে ফুড অথরিটি বেশি করে গড়ে তোলা দরকার। বিশেষ করে বিশ্বের অনেক দেশে এর জন্য শক্তিশালী ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রেশন’ (এফডিএ) আছে। কিন্তু আমাদের দেশে নেই।

জনস্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটের (আইপিএইচ) পরিচালক ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘জিলেটিন’ শিল্পপণ্যের উপকরণ। আমরা ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির মাধ্যমে খাদ্যমান এবং ক্ষতিকর দিকটি দেখে থাকি। হালাল-হারামের বিষয়টি আমরা দেখি না।

এফবিসিসিআই সূত্রমতে, দেশে অন্তত ২০ হাজারের অধিক উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আছে। আর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের (ইফা) তথ্যমতে, এর মধ্যে মাত্র ১৫টি উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের হালাল সার্টিফিকেট রয়েছে। তবে এই প্রতিষ্ঠানগুলোও কতটা হালাল খাদ্য উৎপাদন করে সেটি মনিটরিংয়ের সক্ষমতা নেই ইফার।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. চৌধুরী বাবুল হাসান এ প্রসঙ্গে প্রতিবেদককে বলেন, হালাল-হারাম সম্পর্কিত কোনো আইন ও নীতিমালা দেশে এখন পর্যন্ত তৈরি হয়নি। তাই এ বিষয়ে আমি কোনো কিছু বলতে পারব না। যদিও একই কারণে ইফার এখতিয়ার নিয়েও অনেকে প্রশ্ন তুলছে। আবার এটি সত্য যে, হালাল-হারামের বিষয় দেখভালের জন্য আলাদাভাবে সুনির্দিষ্ট কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি কিংবা জন্মও হয়নি।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. আবুল হোসেন মিঞা এই প্রতিবেদককে বলেন, দেশে ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান।

দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হচ্ছে হিন্দু ধর্মের লোক। বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের লোকও দেশে বাস করে। সবাই নিজ নিজ ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই সবার কাছেই খাদ্য এবং ব্যবহার্য উপকরণ বিষয়ে তাদের নিজস্ব স্বকীয়তা থাকতে পারে। কিন্তু এটিও মনে রাখা দরকার, সবার উপরে মানুষ সত্য তার উপরে নাই। তাই আমি মনে করি নকল, ভেজাল এবং হারাম এসব কিছুই ধর্মীয় রীতিবিরুদ্ধ। সাফ কথা হচ্ছে সব কিছু হতে হবে বিশুদ্ধ এবং হালাল। এর নিশ্চয়তা সরকারকেই দিতে হবে। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানেরও নৈতিকতা থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে ভোক্তাকেও।

আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের ঢাকা জেলা কন্ট্রোলার মো. সাইদুল প্রতিবেদককে বলেন, আমদানি নীতিমালায় ২৮(ক) ধারা অনুযায়ী আমদানিকৃত সব পণ্য বাংলাদেশ মান (বিডিএস) অনুযায়ী বিএসটিআই কর্তৃক প্রত্যেক চালানের পণ্যের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার রিপোর্টসংক্রান্ত প্রত্যয়নপত্র, শুল্ক কর্তৃপক্ষের কাছে আমদানিকারককে দাখিল করতে হয়। এরপরই ওই পণ্য খালাস হয়। তারপর সেটি বাজারে যায়।

তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউশন (বিএসটিআই) সক্ষমতা প্রশ্নের ঊর্ধ্বে থাকছে না। এ প্রতিষ্ঠানের বাধ্যতামূলক তালিকায় ১৫৬টি পণ্য আছে। এর মধ্যে ৬৯টি খাদ্যপণ্য। এর বাইরে অসংখ্য খাদ্যপণ্য দেশে উৎপাদন হচ্ছে। এসব উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের বাজারজাত করা পণ্যের নমুনা বছরে একবার পরীক্ষা করলেও বিএসটিআই তার দায়িত্ব শেষ করতে পারে না। এগুলোর গুণগত মান যেমন তাদের নজরদারিতে রাখা সম্ভব হয় না। তেমনি আমদানি করা হালাল পণ্যের বিষয়টিও তাদের নজরে থাকে না।

তবে বিএসটিআইর সার্টিফিকেশন অব মার্কস (সিএম) বিভাগের পরিচালক কমল প্রসাদ দাস দাবি করেন, দেশে উৎপাদিত ও আমদানিকৃত সব পণ্যের মানই তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকেন। এসব পরীক্ষায় খাদ্যের গুণগত মান এবং ক্ষতিকর উপাদানের বিষয়টি কঠোরতার সঙ্গে দেখা হয়। তবে পণ্যের হালাল-হারামের বিষয়টি নিশ্চিত করতে ইসলামকি ফাউন্ডেশনের বিশেষজ্ঞদের সহায়তা চাওয়া হয়।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনে কর্মরত কয়েকজন মুফতি, মোহাদ্দেস ও মোফাচ্ছের জানান, গুণগত ও স্বাস্থ্যমান বজায় রেখেও হালাল উপায়ে পণ্য উৎপাদন করা যায়। আমদানির ক্ষেত্রেও এর নিশ্চয়তা বিধান সম্ভব। কিন্তু এসব তদারকি সঠিকভাবে হয় না। তারা সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি দুর্বলতা, সমন্বয়হীনতা এবং প্রয়োজনীয় আইনের অভাবকেই দায়ী করেন। হালাল পণ্য তদারকিতে নিজেদের দুর্বলতার কথাও স্বীকার করেন তারা।

জানতে চাইলে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামিম মো. আফজাল এই প্রতিবেদককে বলেন, সরকারি আইন দ্বারা গঠিত দেশে একমাত্র দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। পণ্যের হালাল সনদ ইস্যুর সঙ্গে ধর্মীয় সম্পৃক্ততা রয়েছে। হালাল সনদ দেয়ার এখতিয়ারও তাই ইফার আছে। এর জন্য গভর্নরস বোর্ড আছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত নিয়ে বোর্ড ‘হালাল খাদ্য, ভোগ্যপণ্য, প্র্রসাধন সামগ্রী ও ফার্মাসিউটিক্যালসের সার্টিফিকেট নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। একই বিষয়ে আইনের খসড়াও চূড়ান্ত করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই আইন ও নীতিমালা পাস হওয়ার পর তা কার্যকর হবে।

ওদিকে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সূত্রে জানা গেছে, ভোক্তার সুরক্ষায় তৈরি ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯’ কার্যকর রয়েছে। কিন্তু এই আইনটি পুরোপুরি ভোক্তাবান্ধব নয়। এ আইনে নানা ফাঁকফোকর ও দুর্বলতা আছে। আবার আইনটিতে নকল-ভেজালের কথা বলা হলেও হালাল-হারামের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেয়া হয়নি।

নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম প্রতিবেদককে বলেন, সব ভোক্তার নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে সরকার ‘নিরাপদ খাদ্য আইন’ প্রণয়ন করেছে যা ইতিমধ্যে কার্যকর হচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাও করা হচ্ছে। একই সঙ্গে ‘বিশুদ্ধ খাদ্য আদালত’ গঠন করে এর কার্যক্রম বিস্তৃত করা হচ্ছে। এক প্রশ্নে জবাবে তিনি আরও বলেন, আগের খাদ্য অধ্যাদেশে কোনো ব্যক্তি অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদক, প্রক্রিয়াকারী বা বিক্রেতার বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করতে পারতেন না। বর্তমানে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতে সরাসরি মামলা করারও সুযোগ রয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, নিরাপদ খাদ্য আইন পর্যালোচনায়ও দেখা গেছে এ আইনেও হালাল-হারাম প্রসঙ্গটি সুনির্দিষ্টভাবে টেনে আনা হয়নি। ফলে বিশুদ্ধ খাদ্য আদালতও স্বয়ংক্রিয়ভাবে হালাল-হারামের বিষয়টি কতটা দেখভাল করবে সেটি নিয়ে শংসয় থেকেই যাচ্ছে।

এ বিশ্ব পরিস্থিতিতে জেগে উঠেছেন ইউরোপ-আমেরিকার ভোক্তারা। জানা গেছে, ওইসব দেশে মুসলিম কনজ্যুমারস গ্র“প বা এমসিজি গঠন করা হয়েছে। এমসিজি কোন খাদ্য হালাল বা হারাম তা নির্ণয় করে সার্টিফিকেট দিচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে প্যাকেটের গায়ে এমসিজির সিলও ব্যবহার করছে। ঢাবির ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবম ফারুক মনে করেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জিলেটিন উৎপাদন করতে হবে বিকল্প উপায়ে। ইতিমধ্যে ভেজিটেবল পণ্য থেকে জিলেটিন উৎপাদন হচ্ছে। এর মাধ্যমে ওষুধের খোল বা সেল তৈরি করা হচ্ছে। পাশাপাশি মাছের আইশ, চামড়া, এবং মোরাগর পা থেকেও হালাল উপায়ে জিলেটিন উৎপাদন সম্ভব। এসব থেকে উৎপাদিত জিলেটিন এবং এর থেকে তৈরি পণ্যও সবার কাছে বিশুদ্ধ বলে বিবেচিত হবে।-যুগান্তর
২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এস.এ.সুমন/একে

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে