রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:২৯:৫৯

প্রশ্নবিদ্ধ ডাক্তারদের দিয়ে কী হবে?

প্রশ্নবিদ্ধ ডাক্তারদের দিয়ে কী হবে?

ড. সরদার এম. আনিছুর রহমান : এই তো ১৭ সেপ্টেম্বর পালিত হল জাতীয় শিক্ষা দিবস। সেদিন 'সারা অঙ্গে ব্যথা, ওষুধ দেব কোথা?' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম। নিবন্ধে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে পচন রোগ দেখা দিয়েছে তার একটা সংক্ষিপ্ত চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলাম। দুইদিন পার না হতেই মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় ফের আলোচনার শীর্ষে উঠে এসেছে শিক্ষা প্রসঙ্গটি।

ওই নিবন্ধে লিখেছিলাম-দেশের শিক্ষাবিদরা দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষাব্যবস্থা ও এর ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো নিয়ে কথা বলে আসছেন। তারা বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে সরকার তথা  শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার সমালোচনা করে আসছেন। কেননা, গেল কয়েক বছরে এমন কোনো পরীক্ষা নেই যেখানে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রাথমিক সমাপনী থেকে শুরু করে সব পাবলিক পরীক্ষা, নিয়োগ পরীক্ষা, এমন কী বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্নও ফাঁস হয়েছে। কে শোনে কার কথা! সরকারের পক্ষ থেকে আশাপদ কোন পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।

এইতো গণমাধ্যমে শিরোনাম হয়েছে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর। গেল শুক্রবার অনুষ্ঠিত মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন মহল থেকে। যদিও সরকারের সংশ্লিষ্টরা প্রথম থেকেই তা অস্বীকার করে আসছেন।
 
ফলে এই পরীক্ষা নিয়ে সরকার যাই দাবি করুক না কেন, ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি একেবারেই অমূলক বলা যাচ্ছে না। কেননা, পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার দুদিন আগে থেকেই প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ভেসে বেড়াচ্ছিল। মঙ্গলবার রাতে একই অভিযোগে মহাখালী ডিওএইচএস থেকে নগদ ৩৮ হাজার ও এক কোটি ২১ লাখ টাকার ১৩টি চেকসহ চারজনকে আটক করে র্যাব। এছাড়া শুক্রবার পরীক্ষার দিন আগারগাও থেকে ইউজিসির কর্মকর্তাসহ চারজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। চীন থেকে আমদানিকৃত বিশেষ ধরনের ডিভাইসের মাধ্যমে সেখানে বসে প্রশ্নপত্রের উত্তর দিচ্ছিল বলে জানা গেছে।এ যেন সেই সন্দেহের গুঞ্জনে ঘি ঢেলেছে। ফলে গেল ক'দিন থেকে এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে সমালোচনার ঝড়।
 
এদিকে প্রশ্নবিদ্ধ মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবি জানিয়ে সরকারের তিন সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে শনিবারলিগ্যাল নোটিশ পাঠিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. ইউনুছ আলী আকন্দ।  অ্যাড. আকন্দ বিষয়টি গণমাধ্যমকে অবহিত করে বলেন, শুক্রবার অনুষ্ঠিত ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। ফলে এ পরীক্ষা বাতিল করা না হলে মেধাবি শিক্ষার্থীদের অবমূল্যায়ন করা হবে। তার দাবি, যে প্রশ্নে মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা হয়েছে তাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের মিল পাওয়া গেছে। শুধু তাই নয়, এ পরীক্ষা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বাতিল না হলে রিট করা হবে বলেও জানান তিনি।

তার স্বপক্ষে যুক্তি তুলে বলেন, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক কর্মকর্তাসহ মোট চারজনকে প্রশ্নপত্রসহ গ্রেফতার করেছে। ইতিমধ্যেই ইউজিসি কর্তৃপক্ষ তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্তও করেছে। এছাড়া মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র কোন শিক্ষার্থীর পক্ষে বাইরে বের আনা সম্ভব নয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর প্রতিটি পরীক্ষার কেন্দ্রে পরীক্ষার মোট সংখ্যা হিসাব করে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র (ওএমআর সিট)বন্টন করা হয়। পরীক্ষা শেষে প্রশ্ন ও উত্তরপত্র গুণে মিলিয়ে নিতে হয়। প্রশ্নফাঁসের সাথে একটি বড় চক্র জড়িত।ফলে এই পরীক্ষা বাতিল হওয়া উচিত। সরকারকে তা করতে হবে।

মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করে তা পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিচ্ছু সাধারণ শিক্ষার্থীরাও। শনিবার ঢাকায় মানববন্ধনে তারা এ আহ্বান জানান। এছাড়া খুলনা, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানেও একই দাবিতে কর্মসূচি পালন করেছে শিক্ষার্থীরা।ভর্তি পরীক্ষা বাতিল না করলে তারা কঠোর আন্দোলনে যা্ওয়ারও হুমকি দিয়েছে।

অন্যদিকে রোববার মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম রোববার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে ফল ঘোষণা করার কথা রয়েছে।

তবে এ বিষয়ে সরকার যাই দাবি করুক না কেন, গ্রাম বাংলায় বহুল প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে- যা রটে তাহা কিছু না কিছু ঘটে। ফলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগটি বেশ গুরুতর, কিছু দালিলিক তথ্য-প্রমাণও রয়েছে অভিযোগ উত্থাপনকারীদের কাছে, তাই এ ঘটনায় ওই ভর্তি পরীক্ষার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আর তাই এ পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। সরকারেরর উচিত হবে সবার দাবির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে ঘটনাটি গুরুত্বের সাথে তদন্ত করা, প্রশ্নবিদ্ধ এই পরীক্ষা বাতিল করা এবং পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণ করে ভর্তি কার্যক্রম সম্পন্ন করা। সেই সাথে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার চক্রান্তকারীদের অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা হোক।

আজ জাতি উদ্বিগ্ন, কেননা, বর্তমানে শিক্ষাক্ষেত্র যেন মাছের বাজারের মত। যেখানে জ্ঞানের ভিত্তিতে নয় বরং কালো টাকা ও দুষ্টুচক্রের হাতে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র বিক্রি হচ্ছে। আর এই দুষ্ট চক্রের প্রশ্ন ফাঁস বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেধাবীরা। এ সুযোগে কিছু মেধাহীন শিক্ষার্থী সংঘবদ্ধ চক্রের মাধ্যমে মেডিকেলে ভর্তি হচ্ছে।  

এ নিয়ে এর আগেও অনেক চেচামেচি হয়েছে, কিন্তু ‘কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না’এমন দশা যেন আমাদের। তা নাহলে কী কোমলমতি শিক্ষার্থীরা জানত, প্রশ্নপত্র ফাঁস কিংবা নকল করে পরীক্ষা দিয়ে কীভাবে টাকার বিনিময়ে মেডিকেলে ভর্তি হতে হয়। কিভাবে নিজের পায়ে কুড়াল মেরে জীবনকে ধ্বংস করতে হয়!

প্রসঙ্গত, চলতি বছর ১০ হাজার ২৯৯  টি আসনের বিপরীতে ৮৫ হাজার আবেদন কারীর মধ্যে রেকর্ডসংখ্যক ৮৪ হাজারেরও বেশি পরীক্ষার্থী অংশ নেন। স্বাস্থ্য অধিদফতরের চিকিৎসা শিক্ষা বিভাগের পরিচালকের দফতরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ২৯টি সরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে তিন হাজার ১৬২টি এবং ৬৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পাঁচ হাজার ৩২৫টি আসন রয়েছে। এছাড়া নয়টি সরকারি ডেন্টাল কলেজ ও মেডিকেল কলেজগুলোর ডেন্টাল ইউনিট মিলিয়ে বিডিএস কোর্সে মোট ৫৩২টি ও ২৪টি বেসরকারি ডেন্টাল কলেজে এক হাজার ২৮০টি আসন রয়েছে।

কিন্তু পরীক্ষা প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ উঠায় এ নিয়ে শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই খুবই উদ্বিগ্ন। শিক্ষাকে সাধারণত শিক্ষার্থী বা অভিভাবকরা জীবনে সফল হওয়ার একটি মাধ্যম হিসেবেই বিবেচনা করেন। জীবনব্যাপী শিক্ষা গ্রহণের অভ্যাস ও নেতৃত্বের গুণাবলী তৈরির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্বসমাজের উপযুক্ত, কর্মক্ষম নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার মাধ্যম এটি। এদিক থেকে শিক্ষাকে উৎপাদনশীল একটি শিল্প হিসেবে বিবেচনা করলে বলা যায়, দেশ ও বিশ্বসমাজের উন্নতির জন্য মানুষকে দক্ষ ও আদর্শবান নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলাই শিক্ষার মূল লক্ষ্য। কিন্তু আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কি সেটা করতে পারছে?  শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’হলো- কোনো জাতিকে পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে প্রথমে তার মেরুদণ্ড শক্ত ও সোজা করতে হয়। আমরা দেখতে পাই, শিক্ষায় যে জাতি যত বেশি উন্নত, সে জাতি সব ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। সেই রোমান সভ্যতা থেকে শুরু করে আজকের আধুনিক বিশ্বেও এ প্রতিযোগিতায় এগিয়ে ইউরোপীয়রা। তাদের উন্নতির কথা আমাদের সবারই জানা।

কিন্তু আজ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা আধুনিক বিশ্ব প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া তো দূরের কথা, নানা অনিয়ম আর চরম দৈন্যতায় হাবুডুবু খাচ্ছে! জাতিকে মেধাশূণ্য তথা ধ্বংস করার গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। সেদিক থেকে এগুলো জাতির জন্য এক অশুভ ইঙ্গিত। তাই সরকারের উচিত হবে সবার মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি খতিয়ে দেখে সামনে এগুনো। অন্যথা প্রশ্নফাঁসের প্রশ্নবিদ্ধ এই পরীক্ষার ভিত্তিতে ভর্তি নেয়া হলে প্রশ্নবিদ্ধ চিকিৎসক তৈরী হবে। আর সেসব প্রশ্নবিদ্য চিকিৎসক দিয়ে জাতির কোন কল্যাণে আসবে না। বড়জোর তাদেরকে দিয়ে দলবাজি করা যাবে।এরা পলিটিক্স করবে, নেতৃত্বে আসবে, প্রশাসনের বড় বড় পোস্ট অলংকরণ করবে, তখন এরা দেশের স্বার্থ দেখবে কি কারণে?
লেখক: শিক্ষা ও সমাজ বিষয়ক গবেষক এবং কলাম লেখক। ই-মেইল:[email protected]

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে