রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৭:০৬:১৬

মি’রাজ ও সুলতানের আত্মনির্বাসন (প্রথম পর্ব)

মি’রাজ ও সুলতানের আত্মনির্বাসন (প্রথম পর্ব)

খাঁজা মুহাম্মদ রহমান (কনক সাঁই), এমটিনিউজ : মি’রাজ শব্দের অর্থ উর্ধ্বগমন। সায়্যিদুল মুরসালীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মুজিযাসমূহের মধ্যে অন্যতম এটি। নবীয়ে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দুনিয়াবী ৫০ বৎসর বয়সে রজব মাসের ২৭ তারিখ রাতে মি’রাজে মহান আল্লাহর দিদার লাভ করেন। কোরআনে করীমে বলেন-

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

“পবিত্রতা তাঁরই জন্য যিনি আপন বান্দাকে রাতারাতি নিয়ে গেছেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আক্সা পর্যন্ত। যার আশেপাশে আমি বরকত রেখেছি, যাতে আমি তাঁকে আপন মহান নিদর্শনসমূহ দেখাই; নিশ্চয় তিনি শুনেন-দেখেন।” -(সূরা বনী ইসরাঈল আয়াত -১)

মি’রাজের ঘটনা
রাত দ্বিপ্রহর। ঘন অন্ধকারে আকাশ আচ্ছন্ন। নিস্তব্ধ নির্জন চতুর্দিক। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাবা গৃহের চত্ত্বরে তন্দ্রাচ্ছন্ন। মতান্তরে হযরত উম্মে হানির গৃহে তন্দ্রাচ্ছন্ন। এমন সময় শুনতে পেলেন কে যেন ডাকছে ‘মুহাম্মদ’। এতে হযরতের ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখলেন হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম। তিনি বললেন- ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আল্লাহ্ তায়ালা আপনার সাক্ষাতে ইচ্ছুক। বোরাকও প্রস্তুত। বাহনটি ডানা বিশিষ্ট অশ্বের মত, ক্ষিপ্ত তার গতি বেগ। হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বোরাকের উপর আরোহন করতে অনুরোধ করলেন। যাত্রা আরম্ভ হলো মুহুর্তের মধ্যে মক্কা মুকাররমাহ্ থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছেন। আর আসমান সমূহের ভ্রমণ ও নৈকট্যের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছা নির্ভরযোগ্য, বিশুদ্ধ ও প্রসিদ্ধ বহু হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত; যে গুলো হাদীসে মুতওয়াতির এর কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এর অস্বীকারকারী পথভ্রষ্ট।

মি’রাজ শরীফ জাগ্রতাবস্থায় শরীর ও রূহ মোবারক উভয়টি সহকারেই সংঘটিত হয়েছে। এটিই অধিকাংশ মুসলমানের আক্বীদা ও দৃঢ় বিশ্বাস। সুষ্পষ্ট ও সন্দেহাতীত অর্থ সম্বলিত কোরআনের আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকেও এটি বুঝা যায়।

হযরত জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম এর বোরাক নিয়ে হাজির হওয়া, সমস্ত জাহানের সরদার’কে চূড়ান্ত সম্মান ও মর্যাদা প্রদর্শন পূর্বক আরোহন করিয়ে যাওয়া, বায়তুল মুকাদ্দাস এর মধ্যে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র নবীগণের ইমামতি করা, অতঃপর সেখান থেকে আসমান সমূহের ভ্রমণের প্রতি মনোনিবেশ করা, জিব্রাঈল আলাইহিস্ সালাম’র প্রত্যেক আসমানের দরজা খোলানো, প্রত্যেক আসমানের উপর থেকে অবস্থান রত উচ্চ মর্যাদার নবীগণের তাঁর সাক্ষাৎ লাভ করে ধন্য হওয়া এবং নবীজির প্রতি সম্মান পরিদর্শন করা ও তাঁর শুভাগমনের জন্য মোবারকবাদ জানানো। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র এক আসমান অপর আসমানের দিকে ভ্রমণ করা, সেখানকার আশ্চর্যজনক নিদর্শনাদি প্রদর্শন করা, সমস্ত নৈকট্যপ্রাপ্তদের ঐ চূড়ান্ত গন্তব্যস্থান সিদরাতুল মুনতাহায় পৌঁছা; যেখান থেকে সম্মুখে অগ্রসর হওয়া কোন উচ্চ মর্যাদার ফিরিশতারও অবকাশ নেই। আল্লাহর পুরষ্কারাদি ও বিভিন্ন বিশেষ গুণাবলী লাভ করে ধন্য হওয়া, আসমান ও যমীনের রাজত্ব এবং তদপেক্ষা উত্তম জগতের ও স্থানসমূহ লাভ করা, উম্মতদের জন্য নামায ফরজ হওয়া, হুজুরের সুপারিশ করা, জান্নাত ও দোযখের পরিভ্রমণ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- আমি বোরাক হতে নামিনাই যতক্ষণ পর্যন্ত বেহেশত দোযখ পরিভ্রমণ করি নাই। অতঃপর আপন স্থানে পুনরায় তশরীফ নিয়ে আসা, উক্ত ঘটনার খবর দেয়া, কাফিরদের হৈ চৈ করা, বায়তুল মুকাদ্দাসের ইমামতের অবস্থা ও সিরিয়া গমনকারী কাফেলা সমূহের অবস্থাদি সম্পর্কে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’কে জিজ্ঞাসা করা, হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সব কিছু বলে দেয়া, কাফেলা সমূহের যে সব অবস্থা হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করে ছিলেন, কাফেলাগুলো ফিরে আসার পর সেগুলোর সত্যতা প্রমাণিত হওয়া এসবই বিশুদ্ধ হাদীসসমূহ দ্বারা প্রমাণিত ও নির্ভরযোগ্য।

মুসলিম বিশ্বের স্বর্ণযুগের কথা। মিসরের সুলতান একদা বিতর্কমূলক একটি প্রদেশের জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের এক আলোচনা সভা ডাকলেন। বিষয়টি ছিল- রাসূলে আকরম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র মি’রাজ শরীফ। বিতর্কের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ যা ঘটে থাকে তাই ঘটলো- কোন সর্ব সম্মত মীমাংসায় উপনীত হওয়া সম্ভব হলো না। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মিরাজের রাতে স্বর্গলোক বা মহাশূন্যালোকে ভ্রমণে গিয়েছিলেন। মিরাজে গিয়ে নবীজি বেহেশত ও দোযখ দেখেছিলেন; আল্লাহর সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল -এ ছাড়া আঠারো হাজার জগতের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। তারপর সমগ্র সৃষ্টিলোকের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে ফিরে এসেছিলেন, তখন শয়ন কক্ষের বিছানায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র দেহের উষ্ণতা বিদ্যমান ছিল। শুধু তাই নয়, মিরাজ থেকে ফিরে এসে তিনি দেখলেন যে, অজুর অবশিষ্ট পানিটুকু তখনও গড়িয়ে পড়ছে।

উক্ত আলোচনা কয়েকজন জ্ঞানী ব্যক্তি যুক্তি প্রদর্শন করে বললেন মিরাজের ঘটনা সত্য। স্থান-কাল ব্যবধানের তারতম্যের নিরিখে এটা সম্ভব। মহাজাগতিক শক্তির কাছে সব কিছু সম্ভব, মহাশক্তিশালি সত্ত্বার কাছে আমাদের অচিন্ত্যনীয় সব কিছু অনায়াসে সম্ভব। কাজেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মিরাজ অভিযাত্রা সম্পূর্ণ বাস্তব ও সত্য। কিন্তু বিজ্ঞজনদের এসব যুক্তিতর্ক সুলতান মেনে নিতে পারলেন না। তাঁর বিশ্বাস, এটা ছিল স্বপ্ন বা কাল্পনিকভাবে আল্লাহর আরশ সফর। বিতর্ক ক্রমে জমে উঠলো। মিসরীয় সুলতানের দরবারে এ ধরণের এক চিত্তাকর্ষক অথচ গুরত্ব পূর্ণ তুত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক চলছে; কিন্তু কোন ধরণের মীমাংসা হচ্ছে না। সুলতান মি’রাজকে স্বপ্ন বা কাল্পনিক বলে মনে করেন, এ খবর ক্রমে মিসরের আশে পাশের মুসলিম জাহানে প্রচার হয়ে পড়ল।

সেই সময় সিরিয়ার রাজধানী দামেশকে বাস করছিলেন সূফী সাধক শিরমনি হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি। কথাটা তাঁর কানে পৌঁছল। তিনি কালবিলম্ব না করে মিশরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। তিনি কায়রো পৌঁছানোর সাথে সাথে জ্ঞানীগুণী মহলে সাড়া পড়ে গেল। মিশরের সুলতান ও মুসলিম জগতের এ বিজ্ঞ মনীষীকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে নিজ দরবারে সম্বর্ধনা জানালেন। ইসলামী দুনিয়ার তাসাউফ বা দর্শনের অন্যতম পথিকৃত কামিল বুজুর্গ হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি সুলতানের দরবারে আপন আসন গ্রহণ করেই বললেন- হুজুরে আনওয়ার সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র মিরাজ সম্পর্কে প্রবল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে শুনেই দামেশক থেকে এসেছি। আমি অবিলম্বে এ ব্যাপারে বাস্তব উপলব্ধি লাভের আলোচনা করতে চাই। সুলতান, দুই দল আলিম ও বিজ্ঞ ব্যক্তিদের যুক্তিই ত্রুটিপূর্ণ। মিরাজ সম্পর্কে উভয় দলের ব্যাখ্যা ও যুক্তি বাস্তব উপলব্ধি বর্জিত। মিরাজ এমন বিষয় যা বাস্তব উপলব্ধি ছাড়া কারো পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। এর জন্য অপরিপক্ক জল্পনা কল্পনা অথবা অভিজ্ঞতাহীন বিতর্ক ও যৌক্তিকতার আদৌ কোন প্রয়োজন নেই। সুলতানের দরবারের চার দেয়ালে চারটি প্রশস্ত জানালা ছিল হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে একদিকের একটি জানালা খুলে দিলেন। সুলতান জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলেন অনতি দুরে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বিপুল সংখ্যক হানাদার বাহিনী প্রচন্ড বেগে কায়রোর দিকে আসছে। অতর্কিত হামলার আশঙ্কায় সুলতান আর্ত চিৎকার করে সিপাহ সালারের নাম ধরে ডাকলেন।
বুজুর্গ শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি বললেন- ও কিছু নয় সুলতান! ভুলে যান এ দৃশ্য। তিনি জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে আবার সেটা খুলে দিলেন। সুলতান এবার জানালার দিকে তাকিয়ে পাহাড়ে জনপ্রাণীর কোন চিহ্নই দেখতে পেলেন না।
এবার হযরত শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি অপরদিকের একটি জানালা খুলে দিলেন। সুলতান সে দিকে তাকাতেই দেখতে পেলেন কায়রো শহরে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে, আগুনের লেলিহান শিখা প্রাসাদের দিকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসছে। সুলতান ভয়ে চিৎকার দিলেন- আগুন! আগুন! ‘ঘাবড়াবেন না সুলতান! ও কিছু নয়’ শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি জানালাটা বন্ধ করে দিয়েই পর মুহুর্তে খুলে দিলেন। সুলতান এবার সে দিকে তাকিয়ে দেখলেন- কোথায় আগুন? সুন্দর নগরী রৌদ্রে ঝলমল করছে।

এবার সূফী সাধক দরবারের তৃতীয় জানালাটা খুলে দিলেন। সুলতান সে দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন নীল নদের পানি আকস্মাৎ পাহাড়ের মত ফুঁসে উঠেছে আর উত্তাল তরঙ্গমালায় পাহাড় হুস হুস শব্দে প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এবারও সুলতান আর্ত চিৎকার করে উঠতেই সূফী সাহেব জানালাটা বন্ধ করেই আবার খুলে দিলেন। সুলতান দেখলেন- শান্ত নীল নদ নিঃশব্দে বয়ে যাচ্ছে।

এবার সাধক শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবার চতুর্থ জানলাটা খুলে দিলেন। সুলতান আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। সাহারা মরুর লকলকে তপ্ত জিহবা কোথায়? এ যে বিশাল বিস্তীর্ণ ফলফুলের বাগান! সূফী সাহেব আবার জানালাটা বন্ধ করে দিয়ে নিজের আসনে এসে বসলেন। এবার তিনি হুকুম দিলেন- ‘প্রশস্ত মুখবিশিষ্ট বড় একটা পাত্রে খানিকটা পানি নিয়ে এস।’ পানির পাত্র এলে সুলতানের সামনে সেটা রেখে সূফী শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি সুলতানের পাগড়ীটা খুলে তাঁকে ঐ পাত্রের মধ্যে মাথা ঝুঁকিয়ে কয়েক মুহুর্ত তাকাতে বললেন। সূফীর আদেশ পালন করার জন্য সুলতান মাথা পানির মধ্যে ঝুঁকিয়ে দিলেন। তখনই এক আজব কান্ড ঘটে গেল।
সুলতানের মনে হল তিনি এক নির্জন সমুদ্রতীরে এসে সামুদ্রিক ঝড় ও ঢেউয়ের আঘাতে আঁচড়ে পড়েছেন। সেখানে জনপ্রাণীর কোন চিহ্ন নেই। একটা অজানা নতুন দেশ, সমুদ্রের তীরভূমি, জনবসতি চোখে পড়ছে না।সুলতান মনে মনে দারুন বিক্ষুব্ধ হলেন এমনটা ঘটলো কি করে? নিশ্চয় সেই ধোঁকাবাজ শায়খের কান্ড এটা। যাদুগীর বটে, আমি দেশে ফিরে বেটাকে উচিত শিক্ষা দিব। নিরুপায় সুলতান কি আর করবেন। সমুদ্র তীর ধরে লোকালয়ের সন্ধানে এগুতে লাগলেন। কিছুদুর যাওয়ার পর কয়েকজন কাঠুরিয়ার সঙ্গে তার দেখা হলো। কাঠুরিয়ারা তাকে জিজ্ঞেস করলেন- ‘আপনি কোথা থেকে আসছেন?’ সুলতান আসল পরিচয় ও ঘটনা গোপন রেখে বললেন- আমার জাহাজ ডুবি হয়েছে, এখন আমি বিপন্ন অসহায়। জামা কাপড়সহ সব নষ্ট হয়ে গেছে। কাঠুরিয়া দয়া পরবশ হয়ে সুলতানকে তাদের পরণের জামা কাপড় দিল। অনেক দুর চলার পর সুলতান এক শহরে গিয়ে হাজির হলেন।

শহরে উদ্দেশ্যহীনভাবে সুলতানকে ঘুরতে দেখে এক জন কামার তাঁকে জিজ্ঞেস করলো- আপনি কোত্থকে আসছেন? এ শহরে কাকে খোঁজ করছেন? জবাবে সুলতান বললেন- আমি এক সওদাগর, জাহাজডুবি হয়ে আমি এখন সর্বহারা। কাঠুরিয়াদের দয়ার ওপর নির্ভরশীল। সুলতানের কথা শুনে কামারের মনে দুঃখ হলো। কামার তাঁকে বললো- হে নবাগত, এ শহরের নিয়ম হচ্ছে, দেশের বাইরে থেকে যারা নতুন এ শহরে আসবে, তাদের সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে। গোসলখানায় গোসল করতে আগত নারীদের মধ্যে যারা অবিবাহিতা তাদের যে কোন একজনকে তারা বিয়ে করে সুখ শান্তিতে থাকতে পারে। আর অবিবাহিতা মেয়েরা হাম্মামে (গোসলখানায়) পানির জন্য কোন বিদেশী প্রার্থনা জানাতে এলে তারা পছন্দমত লোককে বিয়ে করেন।

সুলতান কামারের কথামত শহরের একটা হাম্মামখানার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। প্রথম হাম্মামখানা থেকে একটি নারী গোসল করে বেরোতেই সুলতান মহিলাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি বিবাহিতা কিনা। মহিলাটা জানালেন- হ্যাঁ। এভাবে পরপর তিনটি মহিলাকে জিজ্ঞেস করে একই জবাব পেলেন। অবশেষে চতুর্থ মহিলাকে জিজ্ঞেস করে তিনি জানতে পারলেন যে, মহিলাটি অবিবাহিতা। কিন্তু সুলতানের মলিন দারিদ্রক্লিষ্ট পোষাকের দিকে তীর্যক দৃষ্টি হেনে মহিলাটি চলে গেল। সুলতান হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছিলেন, এমন সময়- আকস্মিকভাবে এক ব্যক্তি এসে সামনে দাঁড়িয়ে বললো- কাঁদামাটি মাখা পোষাক পরণে হাম্মামের ধারে আপনিই কি দাঁড়িয়েছিলেন? সুলতান জানালেন হ্যাঁ। লোকটি বললো- মেহেরবানী করে আমার সঙ্গে আসুন।

হাম্মাম থেকে অনতিদুরে এক সুদৃশ্য অট্টালিকার সামনে এসে তাঁরা দাঁড়ালেন। বাড়ীতে প্রবেশ করে সুলতানকে একটি সুসজ্জ্বিত কক্ষে বসতে দেয়া হলো। অল্পক্ষণ করে লোকটি সুলতানের জন্য সুন্দর পোষাক পরিচ্ছেদ এনে দিয়ে সেগুলো পরতে অনুরোধ করলো। সুলতান নতুন পোষাক পরে বসতেই ভিতর বাড়ী থেকে সুন্দর পোষাক সজ্জিত পাঁচটি তরুনী কক্ষের মধ্যে প্রবেশ করলো। সবার পিছনে যে মহিলাটি এল, তাকে দেখে সুলতান চিনতে পারলেন। এই মেয়েটি জবাব দিয়েছিল যে, সে অবিবাহিতা। ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সে সুলতানকে অভিনন্দন জানালো। বললো- দেখুন কিছু মনে করবেন না। আমাদের দেশের নিয়ম এটাই। বিয়ের প্রস্তাব শুনলেই প্রথমে অবজ্ঞা করাই আমাদের রীতি। তারপর ফিরে লোক পাঠানো হয় প্রস্তাবকারীকে ডেকে আনতে। আমাদের নিয়ম এটাই।

অতঃপর মহা ধুমধামের সাথে ক্ষণিকের নির্বাসিত সুলতানের সঙ্গে সেই মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেল।

সুলতান নববিবাহিতা বধুকে নিয়ে সেই শহরে সুখেই দিন কাটাতে থাকেন। ক্রমে তাঁর মন থেকে অতীত জীবনের স্মৃতি মুছে গেলে। দেখতে দেখতে সাতটি বছর কেটে গেল। সুলতানের নতুন স্ত্রীর গর্ভে সাতটি ছেলে মেয়ের জন্ম হলো। বসে খেলে রাজার ভান্ডারও ফুরিয়ে যায়। স্তীর পৈত্রিক সম্পত্তি ও গচ্ছিত টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেল। একদিন সুলতানের স্ত্রী বললেন- আর তো সংসার চলে না। এখন থেকে তাদের ভরণ-পোষণের জন্য সুলতানকে কাজ কর্মের চেষ্টা করতে হবে।

সুলতান কি করবেন, কাজের সন্ধানে রাস্তায় বের হলেন। তখন তাঁর বিপদের দিনের বন্ধু সেই কামারের কথা মনে পড়লো। সোজা কামারের বাড়িতে গিয়ে তিনি তার পরামর্শ চাইলেন। কামার সুলতানকে জিজ্ঞেস করলো ঃ আপনি হাতের কাজ জানেন? সুলতান বললেন- না কিছুই জানিনা। কামার তাকে পরামর্শ দিলো- তাহলে ঝুড়ি নিয়ে বাজারে কুলির কাজ করুন।

সুলতান ঝুড়ি কাঁধে নিয়ে বাজারে গিয়ে হাজির হলেন। সারাদিনে যা দু’একটা কাজ পেলেন, তাতে যা আয় হলো তা দিয়ে হিসাব করে দেখলেন, একদিনে নয় জনের খোরাকির সংস্থান হবে না। হতাশ মনে বাড়ী ফিরলেন।

পরদিন আবার তিনি ঝুড়ি নিয়ে বাড়ী থেকে বের হলেন। রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তাঁর চোখের সামনে অতীত জীবনের স্মৃতি ভেসে উঠলো। মনে পড়লো সেই সমুদ্র সৈকতের কথা, যেখানে প্রথম মুল্লুকে পা রেখেছিলেন। ভাবতে ভাবতে তিনি শহর ছেড়ে সমুদ্র তীরের দিকে পা বাড়ালেন। দেখতে দেখতে নির্দিষ্ট স্থানটিতে এসে পৌঁছলেন। তাঁর হৃদয়ে আবার সাত বছর আগের স্মৃতি ভেসে উঠলো। ভারাক্রান্ত মনে সুলতান নামায আদায়ের জন্য অজু করতে সমুদ্রে নামলেন।

ঠিক সেই মুহুর্তে তিনি যেন নতুন করে সম্বিত ফিরে পেলেন। মাথা উঁচু করে সুলতান দেখতে পেলেন- তিনি মিসরের সিংহাসনে বসে আছেন। সামনেই পানির পাত্র আর নিকটেই দাঁড়িয়ে আছেন হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি। দরবারের সবাই উপবিষ্ট কিন্তু সমগ্র দরবার কক্ষ নীরব। সকলের দৃষ্টি সূফী ও সুলতানের প্রতি নিবন্ধ। সুলতান এবার সিংহের মত গর্জে উঠলেন ঃ ‘সাত বছরের নির্বাসন দন্ড ভোগ করতে হলো। হায়রে দুরাচার! উঃ! সাত সাতটা বছর একটা পরিবার লাভ, বাজারে কুলিগিরির কাজ- উঃ! আপনার কি আল্লাহ রাসূলের ভয় নেই? এ দুষ্কর্মের জন্য আপনাকে আযাব ভোগ করতে হবে।’

সূফীশ্রেষ্ঠ হযরত শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্মিতহাস্যে বললেন ঃ সুলতান আপনি এই পানির পাত্রটার মধ্যে এক মুহুর্ত মাথা হেঁট করেছিলেন। সমাগত পরিষদবর্গ একবাক্যে সায় দিলেন, হ্যাঁ সুলতান! আপনি মাত্র এক পলক পানির পাত্রে উপর ঝুঁকেছিলেন।

কিন্তু সুলতান দরবারের কারো কথাই বিশ্বাস করলেন না। মনে মনে ভাবলেন, এ অসম্ভব, সবই এই সূফীর ভেল্কি। সুলতান মনে মনে স্থির করলেন। দামেশকের এই সূফীকে প্রাণদন্ড দিতে হবে।

ইলমে লাদুনীর অধিকারী হযরত শায়খ শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি সুলতানের মতলব বুঝতে পারলেন। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে সুলতানের সামনে থেকে সরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন এবং মুহুর্তেই দামেশ্কে পৌছলেন। অন্তশক্তির উদ্বোধনের মাধ্যমে সাধকগণ জড়দেহসহ ইথারীয় অদৃশ্য লোকের তরঙ্গমালায় মিলে যেতে সক্ষম হন।

দামেশকে পৌঁছে হযরত শাহাবুদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি মিসরের সুলতানকে এক পত্র লিখলেন-

‘সুলতান! এতদিনে আপনি নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পেরেছেন, একটি মাত্র মুহুর্তের জন্য আপনি পানির পাত্রে মাথা ঝুঁকিয়ে দিয়ে ছিলেন, আর সেই এক মুহুর্ত সময়ের মধ্যে আপনি আপনার জীবনের সাত সাতটা বছর পার করে এসে ছিলেন। আপনার সাত বছর সময়টা আসলে এক মুহুর্তের সমান ছিল। মানুষের মধ্যকার কয়েকটা শক্তিকে সক্রিয় করে কাজে লাগাতে পারলে এই রকম কান্ড ঘটতে পারে। আপনার কাছে সংঘটিত ঘটনার কোন তাৎপর্য নেই। মানুষের মধ্যকার কয়েকটা ইন্দ্রিয়কে সঞ্চালন করতে পারলে এমনটা ঘটতে পারে। আপনার ক্ষেত্রে যেটা সত্যি আল্লাহর রাসূলের ক্ষেত্রে কি তেমনটা ঘটতে পারে না? মিরাজ শরীফ থেকে ফিরে এসে রাসূলের বিছানা কি গরম থাকতে পারেনা? তাঁর অজুর পানির পাত্র থেকে তখনও কি পানি গড়িয়ে যেতে পারে না?

আসল ঘটনা কি ঘটেছে সেটা বড় কথা নয় যেটা গুরুত্ববহ তা হলো, উপাদান। আন্তশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বহু ঘটনা ঘটানো যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- ‘ঘটনার তাৎপর্য কি তা বুঝা।

২৬ মে, ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/ইমো/আইএম

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে