রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:০৭:৫৮

‘আমিই তো ওর বাবা’

‘আমিই তো ওর বাবা’

পাঠকই লেখক ডেস্ক : খুব একটা বিরক্তি নিয়ে সামনে তাঁকিয়ে আছেন আজিজ সাহেব, সচরাচর এমন বিরক্ত তার লাগে না । কিন্তু আজ সব বিরক্তিকর ব্যাপারগুলো যেন একসাথেই ঘটছে। কোনরকমেই যেন নিজেকে সামলাতে পারছেন না আজ। সবচেয়ে বিরক্ত লাগছে সামনে বসে থাকা ছেলেটাকে দেখে। না, ছেলেটা তার কোন ক্ষতি করে নি, তার পরিচিত কেউ ও না, এমনকি কোনদিন কথা বলা তো দূরে থাক আজ মাত্র প্রথম দেখলেন ওকে।

প্রথম দেখাতেই ছেলেটাকে এতোটাই অসহ্য মনে হচ্ছে যে, মনে হয় আর কিছুক্ষণ দেখলে হয় আজিজ সাহেব নিজেই হার্ট-এটাক হয়ে মারা যাবেন অথবা নিজের হাতে ছেলেটাকে খুন করে আসবেন। ছেলেটার প্রতি এতোটা বিরক্তির কারণ আর কিছুই না ছেলেটার পোশাক। খুব টাইট-ফিট একটা শার্ট যেটা মেয়েদের ব্লাউজকেও হার মানায় আর নিচে আরোও টাইট একটা জিন্স যেটাকে মেয়েদের চুজ প্যান্ট বললেই মনে হয় বেশি ভাল হবে।

মাথার চুলগুলো উসকোখুশকো। মনে হয় না গত একবছরের মধ্যে তেল দিয়েছে। গত আধঘন্টা ধরে ছেলেটার দিকে চরম বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে আছেন আজিজ সাহেব। কেন যেন ছেলেটার উপর থেকে চোখ সরাতে পারছেন না। ইচ্ছে করছে এখনই ছেলেটাকে এখনই বাস থেকে লাথি মেরে ফেলে দেন । আজকাল এই সমস্ত ধনীর দূলাল গুলোর জন্যই অন্যান্য ছেলেগুলোও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ভাড়া দেবার টাইম হল।

আজিজ সাহেব খুব মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন ছেলেটা কোথায় নামে, হয়ত বান্ধবীর সাথে ঘুরতে যাচ্ছে কোথাও অথবা বন্ধুদের সাথে মদ-গাজা খাবার আড্ডায় যোগ দিতে যাচ্ছে। কিন্তু আজিজ সাহেবকে একটু ভড়কে দিয়ে ছেলেটা বলল, সে ফার্মগেট যাবে। ফার্মগেটে যদিও এক-একজন মানুষ এক-একটা কাজে যায়। খারাপ ছেলে যেহেতু সেহেতু কোন খারাপ কাজেই যাচ্ছে। সে যাই হোক, ছেলেটাকে আরোও অনেকক্ষণ দেখতে হবে চিন্তা করে তার মন খারাপ হয়ে গেল।

কারণ আজিজ সাহেব নিজেও ফার্মগেটেই যাচ্ছেন, অফিসে। কলেজ রোড থেকে একজন ভদ্র মহিলা উঠলেন। অফিস টাইম, বাস ভর্তি মানুষ, তারপরেও উনাকে উঠতে হল, কারণ এটাতো বাংলাদেশ তাও বার ঢাকার মত একটা শহর, যেখানে আপনার পাশের বাসার মানুষটা তিনদিন ধরে মরে পড়ে থাকলেও আপনি খবর পাবেন চার নাম্বার দিনে, তাও আবার ফায়ার সার্ভিস, এ্যাম্বুলেন্স আর পুলিশের গাড়ির আওয়াজ শুনে। কারও খবর নেবার সময় কারোও নাই।

নেবে কি করে ? মাঝেমাঝে নিজের খবর নিতেই হিমশিম খেয়ে যায়, তার মধ্যে আবার অন্যজনের। যাই হোক, মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন কোনরকমে । সবাই দেখছে কিন্তু কেউ আগ বাড়িয়ে কোন সাহায্য করছে না, বরং যা একটা সিট খালি হয়েছিল তাতে আরেকজন লোক রীতিমত ধাক্কা মেরে বসে গেলেন । মহিলা হিসেবে যে একটা সম্মান দেখাবেন তার বালাই নেই। ঠিক এমন সময় আজিজ সাহেবকে মোটামুটি একটা বড়সড় ভোজবাজি দিয়ে সেই ছেলেটাই উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাটিকে সিট দিল।

রীতিমত আকাশ থেকে পড়ার অবস্থা হলেও নিজেকে কোনরকমে সামলে নিলেন আজিজ সাহেব। তবে এই একটা কাজের জন্যই ছেলেটার প্রতি তার মনোভাব পরিবর্তন হবে না। ছেলেটা খারাপ ছিল, খারাপ আছে, খারাপই থাকবে। অতঃপর একসময় বাস ফার্মগেট এসে থামল । আজিজ সাহেব বাস থেকে একটা বিরাট বড় দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নামলেন। যাক বেয়াদব ছেলেটাকে আর দেখতে হবে না। চিন্তা করেই আশপাশ একটু দেখে নিলেন , নাহ! ছেলেটাকে দেখা যাচ্ছে না।

কত তাড়া এসব ছেলেদের, তিনি নিজে অফিসে যাচ্ছেন, তারও মনে হয় এতো তাড়া নেই, আর এসব অপদার্থ ছেলেগুলো কত তাড়াহুড়ো করে , যেন দুই- তিনটে অফিস চালায় এরা। যত্তোসব, আজিজ সাহেব অফিসে ঢুকলেন। বিরাট বড় অফিস । তিনি এই অফিসের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। সুতরাং অফিসে পা দেয়া হতে শুরু করে নিজের রুমে যাওয়া পর্যন্ত শতাধিক সালাম পাওয়া তার জন্য অস্বাভাবিক কিছুই না।

যাই হোক রুমে এসে বসার সঙ্গে সঙ্গে বশির সাহেবের ফোন আসল, শুভসকাল স্যার , ভাল আছেন? জ্বী ভাল আছি। আপনি ? জ্বী স্যার আপনাদের দোয়ায় আছি ভালই, হুম । বলেন, স্যার বলছিলাম যে, ওই আমার একজন ক্যান্ডিডেট ছিল যাকে আপনি আসতে বলেছিলেন, ও এসেছে, হুম । ঢাকা ভার্সিটি থেকে অনার্স মাস্টার্স, জ্বী স্যার। পাঠাব? -হুম । পাঠান, -জ্বী স্যার, এই ছেলেটার কথা অনেকদিন ধরেই শুনছিলেন বশির সাহেবের কাছ থেকে ।

অনেক সুনাম করেন সবসময় বশির সাহেব। কম্পানিতে একটা চাকরীর জন্য এসেছে আজ। অবশ্য আজিজ সাহেব না দেখেই মনে মনে একটা পোস্ট রেডি করে রেখেছেন ছেলেটার জন্য। কিছুক্ষণ পর দরজায় একটা টোকার শব্দ করে একটা ছেলে গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। আসসালামুয়ালাইকুম স্যার, আসব ? না দেখেই আজিজ সাহেব বললেন, -হুম আস । তারপর নিজের কাজ করতে লাগলেন। কয়েক মিনিট ধরেই এভাবে কাজ করতে লাগলেন, যেন ভূলেই গেছেন ছেলেটার কথা। হঠাৎ মনে হল তার সামনে একটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে । দ্রুতই ছেলেটার দিকে তাকিয়েই আবার আকাশ থেকে পড়ার দশা হল তার, কারণ এটাই হল সেই ছেলেটা যার জন্য আজ অফিসে আসার পুরো রাস্তাটাতেই তিনি অস্বস্তিবোধ করেছেন।

আবারও প্রায় পঞ্চাশ সেকেন্ডের মত ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি। ছেলেটা প্রথম থেকে যেই হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেই হাসি নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। তারপর একসময় বিরক্তি নিয়েই ছেলেটার বায়োডাটাটা হাতে নিতে নিতে বললেন, -নাম কি ? স্যার, রাশেদুল হাসান। -বাবা কি করেন ? -স্যার, বাবা নেই স্যার।

-ও আচ্ছা। আর মা ? -মাআআআআ, ইয়েব মানে স্যার কিছুই করেন না। -এটা বলতে এতো আমতা কেন ? -দুঃখিত স্যার । -হুম । এখন শোন, তোমার চাকরিটা হবে না। কারণ ওখানে অলরেডি আরেকজন জয়েন করে ফেলেছে। -কিন্তু স্যার বশির আংকেল বলেছিলেন, আপনি আমার জন্যই চাকরিটা রেখেছেন। -রেখেছিলাম। কিন্তু এখন আর কিছুই করার নেই । তোমার কিছু বলার আছে? - না স্যার। ছেলেটার গলার মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন আজিজ সাহেব।

কিরকম যেন ভেঙ্গে যাচ্ছে, অনেকটা কাঁদলে মানুষের গলা যেরকম হয়, সেরকম । এতোক্ষণ রাশেদের দিকে না তাকিয়েই কথা বলছিলেন তিনি , কিন্তু এখন কেন যেন তাকালেন। দেখলেন, রাশেদের চোখগুলোও কেমন যেন লাল হয়ে গেছে, যেন এখনই হু হু করে কেঁদে দেবে, তবে চেহারাটা এখনও অনেক শক্ত করে রেখেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক শক্ত মনের ছেলে। সাধারণত গরীবের ছেলেরা যেরকম হয়।

কিন্তু এরকম একটা বেয়াদব ছেলের থেকে আজিজ সাহেব এমনটা আশা করেনি। রাশেদকে তার বায়োডাটা দিতে গিয়ে হঠাৎ আজিজ সাহেবের বাসের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল, মহিলাটির জন্য রাশেদের সিট ছেড়ে দেয়াটা, হঠাৎ কেন যেন মনে হল ছেলেটাকে একটা পুরষ্কার দেয়া উচিত। বায়োডাটাটা আবার নিজের কাছে নিয়ে বললেন, -আচ্ছা একটা পোস্ট খালি আছে। সেকশন সুপারভাইজার, করবে? -জ্বী স্যার অবশ্যই করব স্যার।

রাশেদের মুখে একটা হাসির ঝলক দেখা গেল , যেন কি এক আমূল্য ধন পেয়ে গেল। আজিজ সাহেব অবশ্য ইচ্ছে করেই এই পোষ্টটার কথা বললেন । কারণ এই পোস্টের কাজটা একটু নিম্নমানের, অন্ততপক্ষে একটা ঢাকা ভার্সিটি থেকে মাস্টার্স করা ছেলের জন্য তো বটেই, সারাদিন লেভারদের সাথে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়, দিনের মধ্যে এক ঘণ্টাও মনে হয় বসা যায় না। এই পোস্টে কোন মানুষই বেশিদিন টিকে না। এই সব কথাই তিনি রাশেদকে বললেন।

কিন্তু রাশেদের উৎসাহ এতোটুকু দমাতে পারলেন না। শেষে অনেকটা বিরক্ত হয়েই বললেন, ‘যাও কাল থেকে কাজ শুরু করে দিও’। তখন রাশেদ এমন কিছু একটা করল যাতে শুধু আজিজ সাহেব কেন , পৃথিবীর যেকোন মানুষই খুশি হয়ে যাবে। সে আজিজ সাহেবের পায়ে ধরে সালাম করে বসলো। রাশেদ যাবার পর আজিজ সাহেব নিজের সাথে নিজেই চ্যালেঞ্জ ধরলেন, এই ছেলে যদি এই পোশাকে ত্রিশ দিনের বেশি এই চাকরী করে তাহলে তিনি ওকে তার একদম ক্রমিক নিচের পোস্টটাই দিয়ে দেবেন।

ম্যানেজার এডমিন, পরবর্তী ত্রিশদিন তিনি ওকে খুব কড়া নজরে রাখলেন। শুধুমাত্র দুপুরের লাঞ্চটাইমটা ছাড়া রাশেদকে বসতে দেখেননি আজিজ সাহেব। তারপর ধীরে ধীরে একসময় ত্রিশনাম্বার দিনটাও পার হয়ে গেল। যার মানে হল নিজের সাথে নিজের চ্যলেঞ্জে আজিজ সাহেব হেরে গেছেন । চ্যালেঞ্জ অনুসারে এখন ম্যানেজার এডমিন পদে রাশেদকে বসাতেই হবে। রাগে দুঃখে আজিজ সাহেবের মনে হল তিনি এখনই রাশেদকে খুন করে ফেলবেন । কিন্তু তা তো অসম্ভব। তারপর তিনি একটা উপায় খুঁজতে লাগলেন, কিভাবে রাশেদের চাকরীটা খাওয়া যায়। ঠিক করলেন, আজ সারাদিন-রাত ওকে দিয়ে কাজ করাবেন, একেবারে অমানুষিক কাজ যাকে বলে, যেমন ভাবা তেমন কাজ।

ইচ্ছে করেই রাশেদকে ওভারটাইম দিলেন আজিজ সাহেব। রাশেদ শুধু একবার বলেছিল, ওর মা অসুস্থ, আজকে একদিনের জন্য ওকে ছেড়ে দিতে । কিন্তু আজিজ সাহেব এতোটাই রেগে ছিলেন যে তার কথা কানেই নেননি । বরং রাত ১০টা পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজিয়ে ভিজিয়ে কাজ করিয়েছেন। মাঝে একবার একটা বাক্স উপরে তুলতে গিয়ে রাশেদের সেই চাপা জিন্স প্যান্টটার একজায়গায় ছিড়ে যায়। এটা দেখে আজিজ সাহেব যেন অট্ট হাসিতে ফেটে পড়লেন।

আজ যেন তার জীবনের সেরা দিনটা পার করলেন। একটা পৈশাচিক আনন্দ নিয়েই যেন সেদিন বাড়ি ফিরলেন। পরদিন চ্যলেঞ্জ অনুসারেই রাশেদকে প্রমোশন দিয়ে দেবেন ঠিক করলেন আজিজ সাহেব। কিন্তু রাশেদের সেকশনে গিয়ে দেখলেন এখনও রাশেদ আসে নি। তারপর অপারেটরকে বললেন , রাশেদ আসলে যেন সোজা তার রুমে পাঠিয়ে দেয়। বলেই নিজের রুমে এসে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ১০টার দিকে একবার বের হলেন আজিজ সাহেব।

ঠিক তখনই রাশেদকে দেখলেন হন্তদন্ত হয়ে অফিসে ঢুকছে। প্রথমে অনেকটা শান্তভাবেই প্রশ্ন করলেন, কেন দেরি হয়েছে । রাশেদ জানাল, মায়ের অসুস্থতা একটু বেশি বেড়ে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালে নিতে হয়েছিল। আর প্যান্টটা সেলাই করতে করতে আরেকটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এসব কথা যেন আজিজ সাহেবের কানেই গেল না। তিনি যাচ্ছে তাই ভাবে তাকে গালিগালাজ করতে লাগলেন। রাশেদ কিছুই বলল না। শুধু মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।

তারপর একসময় তিনি রাগের মাথায় রাশেদকে বের হয়ে যেতে বললেন। আর কোনদিনও যেন এই অফিসে না আসে সেই কথাও জানিয়ে দিলেন । এবার রাশেদ কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু আজিজ সাহেব শুনলেনই না  বারবার করে বেরিয়ে যেতে বললেন। তারপর রাশেদ একসময় হাল ছেড়ে দিয়ে দরজার দিকে পা বাড়াল। কিন্তু দুই তিন কদম দিতেই হঠাৎ ধুম করে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে গেল। সাথে সাথে কাছাকাছি যারা ছিল তারা ওকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গেল ।

আজিজ সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলেন , কিছুই করতে পারলেন না। আসলে কি করবেন ঠিক বুঝতেই পারছিলেন না। হঠাৎ লক্ষ্য করলেন ফ্লোরের দিকে। সেখানে অনেকগুলো পানি জমে ছিল । অনেকগুলো ফোটায় ফোটায় জমে থাকা পানি । মনে করে দেখলেন ওই জায়গাটাতেই রাশেদ দাঁড়িয়ে ছিল, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিরবে কেঁদে যাচ্ছিল।

হাসপাতালের বেডে রাশেদের পাশে বসে আছেন আজিজ সাহেব। নিরব দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে আছেন একটা ছেলের দিকে, যাকে এতোদিন শত্রু মনে করতেন। হঠাৎ করে লক্ষ্য করলেন চোখ দুটো কেমন যেন ঝাপসা হয়ে আসছে । হ্যা, আজিজ সাহেব কাঁদছেন কিন্তু কেন কাঁদছেন? তার তো আজ কাঁদার কথা নয়। বরং হাসার কথা, কারণ সামনে বেডে শুয়ে থাকা বেয়াদব ছেলেটা, যে কিনা কোন দোষ না করেই তার পরম শত্রু বনে গেছে, সে বর্তমানে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে।

কয়েকদিন আগেও যে ছেলেটাকে একেবারে সহ্য করতে পারতেন না সেই ছেলেটার সম্বন্ধে হঠাৎ করেই এমন কিছু শুনলেন আজ, যার কারণে কয়েক মুহূর্তেই তার সম্পূর্ণ রাগটা উল্টো নিজের উপরই এসে পড়ল। দিনাজপুর জেলার এক প্রত্যন্ত্য অঞ্চলের ছেলে রাশেদুল হাসান। ডাকনাম শানু । খুব ছোট বয়সেই বাবা-মাকে হারানো শানু জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কাটিয়েছে লড়াই করে। নিজের জন্য লড়াই, অস্তিত্যের জন্য লড়াই । লেখাপড়ায় খুব ভাল করার ফলাফলস্বরূপ একসময় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা ভার্সিটিতে চান্স পেল শানু কিন্তু ঢাকায় পরিচিত কেউ ছিল না তার।

ফার্স্ট ইয়ারে হলে সিট পাওয়া খুবই দুষ্কর ছিল তখন। নিরুপায় হয়ে একসময় যখন ঢাকা ভার্সিটির স্বপ্ন ধূলিস্যাৎ হয়ে যাচ্ছিল ঠিক তখন উপরওয়ালার পরম করুণায় দেখা হয়ে যায় শানুরই গ্রামের একজন খালার সাথে যিনি মানুষের বাসায় কাজ করে করে কোনরকমে জীবনযাপন করেন। নাহ! খালা বললে ভূল হবে, বলতে হবে মা। কারণ তিনি যে একেবারে মায়ের মতই আগলে রেখেছিলেন এই কয়েক বছর। তারপর আর কি ! খালার সাথেই শুরু হয় শানুর নতুন জীবন।

খালা কোনরকমে দুবেলা দুমুঠো জোগাড় করেন আর শানুও টিউশনি করে কিছু সাহায্য করে, এভাবেই কেটে যাচ্ছিল দিন। দিনে আনে দিনে খায়, কোন আশা নেই, কোন আকাঙ্খা নেই, নেই কোন উচ্চাশা । ভার্সিটিতে যাবার জন্য একটাই শার্ট ছিল শানুর , এতোগুলো বছর ধরে এই একটা শার্ট পড়েই ভার্সিটি গেছে ও। কেউ কোনদিন জিজ্ঞেসও করে নি, “কিরে তোর আর কি কোন শার্ট নেই ?” করবেই বা কে? ওর সাথে যে কেউ মিশেই না। আর যদি মিশেও তাও কোন না কোন স্বার্থের জন্যই, আর একবার টিউশনিতে ছাত্র ভাল রেজাল্ট করাতে ছাত্রের বাবা খুশি হয়ে তাকে একটা জিন্স প্যান্ট দান করেন।

অতএব এই দুটোই তার বাইরের চাকচিক্যময় সমাজের সাথে মিলনের সম্বল। কোনদিন নতুন কোন শার্ট বা প্যান্ট কেনার সাহসও করেনিও । করবে কেন? ওর থেকে তো সেই স্বপ্ন দেখার অধিকার টুকুও কেড়ে নেয়া হয়েছে, কেনা তো অনেক দূরের কথা। কিন্তু এতোকিছুর পরেও সে নিজেকে অনেক সুখী মনে করত, হয়তো বা অল্পেতেই খুশি ছিল সে কিন্তু বেশিদিন এভাবে চলল না। সবকিছু কেমন যেন খুব দ্রুত শেষ হয়ে গেল । হবে না ই বা কেন !

সুখ নামের একটা সোণার হরিণকে যে পৃথিবীতে আসার সময়ই উপরওয়ালা থেকে খুঁজে আনতে হয়। হয়ত শানু নামের ছেলেগুলো সেই সোণার হরিণটাকে খুঁজে আনেনি। শানুর গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট হবার আগেই হঠাৎ করেই একদিন খালা অসুস্থ্য হয়ে যান । ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলে জানা যায় , খালার ব্লাড ক্যান্সার হয়েছে, ব্যস! শুরু হয়ে গেল শানুর নতুন সংগ্রাম। মাকে আর বাবাকে যেভাবে হারিয়েছে, এখন শেষ আশ্রয় এই খালাকেও আর সেভাবে হারাতে চায় না শানু।

কোনভাবে গ্রেজুয়েশন কমপ্লিট করল শানু । কিন্তু এদিকে খালার অবস্থা দিন দিন খারাপ থেকে খারাপের দিকে এগুতে থাকল । ডায়লাইসিসের জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন পড়ল । তাই হন্যে হয়ে একটা চাকরী খুঁজতে লাগল শানু । কিন্তু আজকালকার দিনে মামা-চাচা ছাড়া কে চাকরী দেবে ? এমন সময় তার ছাত্রের বাবা বশির সাহেবের শরণাপন্ন হল শানু । প্রথম প্রথম বশির সাহেবও তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু অনেক কাকুতি-মিনতির পর তিনি রাজি হলেন।

তারপরের ঘটনা সবারই জানা। ডাক্তারের ডাকে এতোক্ষন পর সম্বিত ফিরে পেলেন আজিজ সাহেব । ডাক্তার জানালেন অতিরিক্ত চাপের কারণে হার্ট দুর্বল হয়ে গেছে । কিন্তু সমস্যা সেটা না, সমস্যা হল খাওয়া-দাওয়ার বেহিসেবের কারণে কিডনিতে পাথর জমে গেছে। এখন অপারেশন করতে হবে । প্রচুর টাকাও প্রয়োজন। আত্নীয়-স্বজন কাউকে খবর দিতে পারলে ভাল হয়। বলেই ডাক্তার চলে গেলেন।

আজিজ সাহেব চিন্তা করলেন বশির সাহেবকে দিয়ে শানুর খালাকে খবর দেবেন। এই চিন্তা করেই উঠে যাবেন এমন সময় অনুভব করলেন তার হাতটা শানু ধরে রেখেছে। কিছু একটা বলতে চাচ্ছে ও। ওর মুখের কাছে কান নিয়ে গেলেন আজিজ সাহেব। ও বলল, “স্যার, আমি আর বাঁচব না। আমার শেষ একটা মিনতি রাখবেন, আমার গতমাসের বেতনটা দিবেন দয়া করে? তাহলে খালাকে আর কয়েকদিন বাঁচাতে পারতাম” কথাটা শুনে ঠিক বলবেন বুঝতে পারছিলেন না আজিজ সাহেব।

গলাটা কেমন যেন ধরে গেছে ওনার, চোখগুলো আর সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু কান্নাটা শানুকে দেখানো যাবে না। তাই মাথা নেড়ে সায় দিয়ে কোনরকমে চলে এলেন তিনি। হাসপাতালের করিডোরে ছন্নছাড়া পথিকের মত বসে আছেন আজিজ সাহেব। চোখদুটো বরাবর সামনে স্থির হয়ে আছে , যেখানে রুখসানা বেগম নামের একজন চল্লিশোর্ধ মহিলার লাশ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই মাত্র মারা গেছেন তিনি। আর এর সাথে সাথে আরেকটা স্বপ্নেরও ইতি ঘটিয়ে গেলেন উনি। কারণ এই মহিলাটিই ছিলেন শানুর সেই খালা, যার জন্য নিজের জীবন তুচ্ছ করে লড়াই করে গিয়েছিল শানু।

ধীরে ধীরে শানুর কেবিনের সামনে আসলেন আজিজ সাহেব। ঘুমোচ্ছে ছেলেটা। হয়তো কিছু সময় পরে সারাজীবনের মত ঘুমিয়ে যাবে। অবশ্য ও ঘুম থেকে উঠেই বা কি করবে ? ওর সব কাজ তো শেষ। এখন একটু বিশ্রাম দরকার কিন্তু হঠাৎ শানুর নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে অন্য কারো কথা মনে পড়ে গেল আজিজ সাহেবের । তার মেয়ের কথা । বেঁচে থাকলে হয়ত শানুর মতই হত এতোদিনে। কিন্তু দশ বছর আগে একটা রোড এক্সিডেন্টে সবকিছু লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল।

তারপর থেকে তার পুরো দুনিয়াটাই অন্যরকম হয়ে গিয়েছিল । ভালবাসা, আদর, স্নেহ, মমতা, এই সবকিছুই তার থেকে হারিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আজ এতোদিন পরে শানুকে দেখে কোথা থেকে যেন এই ব্যাপারগুলো তার মধ্যে চলে আসল বুঝতেই পারছেন না। হঠাৎ আজিজ সাহেব ঘুরে দাঁড়ালেন। হ্যাঁ  তিনি আবার স্বপ্ন দেখতে চান, স্বপ্ন দেখাতে চান আর সেই স্বপ্ন পূরণও করতে চান। শানু নামের এই ছেলেটাকে তিনি বাঁচাতে চান, ছেলেটাকে স্বপ্ন দেখাতে চান। ডাক্তারের কাছে দিয়ে বললেন অপারেশনের সব ব্যবস্থা করতে, টাকার জন্য যেন কোন চিন্তা না করেন। তারপর ডাক্তার ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি রোগীর কি হন ?” উত্তরে আজিজ সাহেব মুখটা শক্ত করে, গর্বের সাথে বুক চাপরে বললেন, “আমিই তো ওর বাবা”।

লেখক : অচেনা অমিত

১৯ এপ্রিল ২০১৫/এমটিনিউজ২৪/এসএস/এসবি

 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে