রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:২০:০৭

নিষ্ঠুর পৃথিবী

পাঠকই লেখক : সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ নাই। গরমে গা বেয়ে ঘাম পড়ছে। বাহিরে মৃদু-মন্দ হাওয়া বইছে, তাই বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার পর থেকে ছাদেই আছি। আকাশে তাঁরার মেলা বসেছে। প্রতিটা তারা মেলার একেকটা স্টল আর তাদের তদারকির দায়িত্ব পালন করছেন মিস্টার শশধর(চাঁদ)।

অফিসের অলস বসদের মতন মিস্টার শশধর'ও কোন অংশে কম নন, এক জায়গায় বসে পুরো এলাকা তদারকি করছেন। ওনার কাছে শক্তিশালী আলো আছে তো তাই নড়াচড়া না করলেও চলে। যখন আলো থাকবে না তখন বুঝবে মজা। আরাম হারাম হয়ে যাবে।

আচ্ছা আকাশে কি কখনও কারেন্ট যায় না! লোড-শেডিং হয় না! ইশ ওদের কি মজা। আমাদেরও যদি আকাশের আলোকসজ্জার মতো অফুরন্ত বিদ্যুৎ থাকতো, কত্ত মজা হতো।

- কিরে ভাই, কি ভাবস?
- কিছু না।
- তোর আজ ইন্টারভিউ'এর কি হইলো। চাকরিটা কি হবে নাকি কালকেই আবার ইন্টারভিউএর জন্য দৌড়াইতে হবে।
- তুই সব সময় বেশি কোথা বলস। দিলি তো মুডটা নষ্ট কইরা। যা, ভাগ এইখান থিকা...।
আমার ছোটভাই, সব সময় দুই লাইন বেশি কোথা বলে কিন্তু একবার জোরেসোরে বকা দিলে প্রভুভক্ত কুকুরের মতো লেজ গুটিয়ে স্থান ত্যাগ করে। এবারও তার ব্যতিক্রম হল না।

ইশ, বাড়িতে এই ছোটভাইগুলার যন্ত্রণায় এক মুহূর্ত শান্তিতে থাকা যায় না। মনটাই খারাপ করে দিলো। সজল বলতো, "মন খারাপ হলে চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকবি। দেখ, চাঁদটা একাই পুরো আকাশ আলোকিত করছে। তার ভেতরেও কষ্ট আছে, সে একা। একাকীত্ব জীবন বড়ই যন্ত্রণার। কিন্তু তবুও সে তার কাজ ঠিকভাবে করে যাচ্ছে। জীবনে সুখ-দুঃখ তো থাকবেই, এর জন্য হাত-পা গুটিয়ে, মুখটা বাংলার পাঁচএর মতো করে বসে থাকলে চলবে?"

আজ সজলের কোথা ভীষণ মনে পড়ছে। আমার স্কুল এবং কলেজ লাইফের বন্ধু। খুবই শান্ত-শিষ্ট আর লাজুক একটা ছেলে। প্রতিবাদ করা বলেতে ও বুঝত চুপ করে থাকা আর দিন শেষে ঘুমানোর আগে মনের প্রতিবাদগুলো
ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করা। কেউ ওর খাতা কেড়ে নিলেও ও চুপ করে থাকতো আবার কেউ ওর টিফিন চুরি করে খেলেও ও চুপ করে থাকতো।

এমন একটা ছেলে কলেজে ওঠার পর হঠাত করেই কেমন যেন পাল্টে যায়। যে সন্ধ্যা ৭টার আগে কখনও বাড়ির বাহিরে থাকে নি, সে হঠাত করে রাত ১০টা-১১টায় বাড়ি ফেরে। আমাদের প্রাইভেট স্যারের বাসা থেকে ওর বাসা হেঁটে গেলে মোটামুটি ১ ঘন্টার পথ। মাঝে মাঝে ওকে দেখতাম পকেটে টাকা থাকা সত্ত্বেও ও হেঁটেই বাড়ি ফিরত।

একবার ওকে জিজ্ঞেস করলাম," দোস্ত তোর কি টাকার সমস্যা? তুই হেঁটে বাড়ি যাস কেন? আমি যতদূর জানি আংকেল-আন্টি তোকে টাকা দেয় রিক্সা করে বাড়ি ফেরার জন্য।"
- সব সময় তো হেঁটে যাই না, যখন মন খারাপ থাকে তখন হেঁটে যাই। হাঁটলে মন ভালো হয়ে যায়।
আদৌ কি ওর মন ভালো হতো কি না, জানতাম না। ওকে চেষ্টা করেছি ও কাছ থেকে ওর আসল সমস্যা জানার।
কিন্তু ও বলতে গিয়েও আটকে গেছে। ওর কষ্টগুলো ছিল বিজলির মতো, সব সময় আলোর ঝলকানি দিতো। যে আলোগুলো আগুনের রুপ নিয়ে ওর বুক চিঁড়ে বের হয়ে আসতে চাইত। কিন্তু ও বারবরই তা চেপে রেখেছে।

শুনেছিলাম যাদের বেশি কষ্ট তারা নাকি নেশা করে। নেশা করলে নাকি কষ্ট কমে। তাই একবার সজলকে বলেছিলাম, "দোস্ত, তোরে দেখলে মনে হয় তুই কষ্টের সাগরে বিরামহীনভাবে সাঁতার কাটস। আচ্ছা, তুই কি নেশা করছ, দোস্ত??"
ও বলতো," নেশা করতে পারলে হয়ত ভালোই হইত, অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও টেনশনগুলো থেকে মুক্তি পাইতাম, আজকাল আর ঘুমায়েও শান্তি পাই না।"

ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোন ভাষা আমার জানা ছিল না। কারন আমি জানতাম না ওর কষ্টটা ঠিক কোন জায়গায়।
একদিন হঠাত রাত ১০টার দিকে ও আমার বাসায় আসে...
- কিরে দোস্ত, এতো রাতে! কোন সমস্যা??
- না। তোকে একটা জিনিস দিতে এসেছি।
বলেই সে ব্যাগের ভেতর থেকে ওর ডায়েরিটা বের করে আমায় দিলো।
আমি বললাম," হঠাত তোর পার্সোনাল জিনিস আমাকে দিলি যে??" ও কোন কথা না বলেই চলে গেলো।

রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ডায়েরীটা পড়া শুরু করলাম। প্রথম দিকের কোন লেখাই বোঝা যাচ্ছিল না। সব শুধু কাটা-কুটি দিয়ে ভরা। লেখার চেয়ে কাটাকুটিই বেশি। শেষমেশ পড়ার মতো লেখা খুঁজে পেলাম।

"প্রত্যেকটা ঘটনা লেখার শুরুতে তারিখ দেই না। কিছু কিছু ঘটনা আছে যেগুলো পরবর্তীতে অনেক কষ্ট দিতে পারে, তাই সেগুলো লেখার সময় তারিখ-সময় এসব উল্লেখ করি না। যে জিনিসগুলো কষ্ট দেয়, সেগুলো লেখার কি দরকার তাহলে? লিখি, মনের খেয়ালে লিখি। হয়ত সাময়িক ভাবে কষ্টগুলো বের করে আনতে পেরে নিজের মনটাকে একটু হালকা করতে
পারি।

নতুন জায়গায়,নিজের বাসায় উঠেছি আজ প্রায় তিন মাস হল। শুরুটা ভালোই ছিল। বরারবরি নতুন পরিবেশ আমার খুব ভালো লাগে। আশেপাশের মানুষও অনেক ভালো। কিন্তু সমস্যা হল আমার ছোট বোন "সাথিকে" নিয়ে। সবে ও ক্লাশ এইটে উঠেছে। এর মধ্যেই এলাকার কিছু মস্তান ছেলের কু-দৃষ্টি ওর ওপর পরে। একটি ছেলে মাঝে মাঝে আমার বোনকে রাস্তায় আটকাতো, আজে-বাজে কোথা বলতো। প্রেমে রাজী না হলে ওকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতো। একদিন হঠাত এই ঘটনা আমার সামনে ঘটে। ছোটবেলা থেকেই ঝামেলা থেকে আমি ১০০ হাত দূরে থেকেছি। প্রতিবাদ কিভাবে করতে হয় আমি জানি না। আমি সাথিকে বাসায় যেতে বলে ওই ছেলেটার সাথে কিছুক্ষণ কোথা বললাম। অনেক অনুরোধ করলাম, বললাম," ভাই, প্লিজ, আমার বোনের ভবিষ্যৎটা নষ্ট করবেন না। ও সবে ক্লাশ এইটে পড়ছে। দয়া করে ওকে একটু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দিন।"

কিন্তু ওরা আমার কোন কথাই শুনল না, আমার আকুতিগুলোকে হেসেই উরিয়ে দিলো। সেদিন রাতে আর ঘুমাতে পারলাম না। যখনি আমার বোন বাসা থেকে বের হয় তখনি ওই ছেলেটা আসে। আমার সামনে আমার বোনের দিকে কু-দৃষ্টি দেয়, খারাপ মন্তব্য করে। গায়ের রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে কিন্তু কিছু করতে পারি না। এইসব ছেলেদের দিকে ইট ছোঁড়া মানে বিনিময়ে পাটকেল খেতে হবে। না পারছি সহ্য করতে না পারছি বাবা-মাকে বলতে আমার বাবা একজন হার্টের রোগী। এর আগে দুইবার তার স্ট্রোক হইছিল। আর আমার মা এসব শুনলে হয়তো মরেই যাবে।

বোন আমার প্রতিদিন আমার কাছে এসে কাঁদে, আমিও ওর সাথে কাঁদি। কাপুরুষদের দ্বারা তো এর চেয়ে আর বেশিকিছু সম্ভব না। প্রতিটা মুহূর্ত ডাঙ্গার মাছের মতো ছটফট করি অথচ কোন উপায় খুঁজে পাই না। একবার চেয়েছিলাম বড় কারো সাহায্য নিয়ে ছেলেটার নামে কেস করতে। কিন্তু কি লাভ! একদিন তো ঠিকই জেল থেকে ছাড়া পাবে, তখন কি হবে! কষ্টগুলো প্রতিনিয়তই নরক-যন্ত্রণার মতো বেড়েই চলেছে।"

এই ঘটনাগুলো পরে আঁতকে উঠলাম, ফ্যানের এত বাতাস থাকা সত্ত্বেও নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। ডায়েরীটা আর পড়তে ইচ্ছা করছিলো না। বারবার শুধু মনে হচ্ছিলো কেন মিছিমিছি পড়তে গেলাম অন্যের ডায়েরী।
ডায়েরীতে আর কিছু লেখা ছিলো না। শেষ পেইজে দেখি, সেখানে লেখা,

" আমাকে মাফ করে দিস বোন। তুই আমার কাছে
ক্যামিস্ট্রি পড়তে চাইছিলি, আমি তোকে পড়াতে পারলাম না। ওরা তোকে নাইন'এ উঠতে দিলো না। বাবা-মার কত স্বপ্ন ছিল তোকে ডাক্তার বানাবে। কিন্তু ওই পশুরা তোর স্বপ্নগুলো পুরন করতে দিলো না। আমি এক অধম, কাপুরুষ। আমার মতো ভাই যেন কোন বোনের কপালে না জোটে।"

রাত ২টা বেজে গেছে। এখন সজলের বাসায় যাওয়া সম্ভব নয়। ওর ফোন নাম্বার বন্ধ। পরেরদিন সকালে ওদের বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি বাসার বাহিরে পুলিশের গাড়ি, ভিতরে অনেক ভীর। হাতে হাত-কড়া পরিয়ে দুইজন পুলিশ ওকে গাড়িতে তুলল। যাবার আগে ও বারবার চিৎকার করে বলছিল," আমি আমার বোনের হত্যাকারীর প্রতিশোধ নিয়েছি, মা। হাহাহা...। সাথির আর কোন ভয় নাই। হাহাহা...। ওকে কাল থেকে আবার স্কুলে পাঠাবে মা। ওকে কিন্তু সায়েন্সে দিবা মা। ও ডাক্তার হয়ে তোমাদের স্বপ্ন পুরন করবে। হাহাহা... আমি রাস্তার সব আগাছা কেটে ফেলেছি হাহাহাহা...।
পরে জানতে পারলাম, সাথিকে ওই ছেলেটা তুলে নিয়ে গিয়েছিল।পরের দিন সাথি বাসায় ফিরে আসে। ওর বাবা-মা, ভাই ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে কিন্তু সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ও ফ্যানের সাথে ওড়না বেঁধে আত্মহত্যা করে।

(আমার মা):- কিরে বাবা, কাঁদছিস কেন??
(আমি):- না, মা, এমনি। সজল আর ওর বোনের কোথা খুব মনে পরছিল তো।
(আমার মা):- মন খারাপ করিস না, বাবা। পৃথিবীটা অনেক নিষ্ঠুর রে, কাউকে ভালোভাবে বাঁচতে দেয় না।

লেখক : মিরাজ উল কবির

১৮ নভেম্বর ২০১৪/এমটিনিউজ২৪/এসবি/এসএস

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে