রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৯:৫১:৪৭

আলোর ছায়া আঁধার

পাঠকই লেখক : তখন মোমবাতি জ্বলত ঘরে। ঘরের ছেলে মেয়ে গুলো সেই মোমবাতি ধরিয়ে পড়ে যেত, অ তে অজগরটি ঐ আসছে তেড়ে। তখন দুজনের ফিসফিস আলাপ হত। মোমবাতির একটু আলোর চারপাশ ঘিরে অনেকটা আঁধার। তবুও আঁধার বুকের মাঝে আলোটুকু আঁকড়ে রাখত। আলো মাঝে মাঝেই বলত, ছেড়ে যাবে না তো কখনও?

চুপ করে বাহিরের অতল সীমাহীন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আঁধার বলত, কখনও না।
- আস্তে আস্তে যদি সব আলো সারাজীবনের জন্য নিভে যায় তাহলে?
আঁধার মুচকি হেসে বলে, ভেবো না। পৃথিবী আলোর দিকে যাচ্ছে। তুমি দিন দিন বাড়বে, আমি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাব।
- ইশ বললেই হল?

- হ্যাঁ বললেই হল। এমনই হবে দেখো। তখন আবার আমাকে ভুলে যেও না। অনেক রঙের আলো পেয়ে।
- আলোর আবার রঙ হয় কোন?
- হয় হয়। লাল হয়, নীল হয়, বেগুনী হয়, হলুদ হয়, ঐ যে ছোট ছেলেটা পড়ছে সবুজ জামা পরে তেমনও হয়।
- কি বল? তুমি দেখেছ কখনও?
- তা দেখিনি। তবে গল্প শুনেছি অনেক। শুনেছি, সেসবের ভিড়ে নাকি আঁধার পাত্তাই পায় না।
- আমি কিন্তু তেমন না। তোমাকে অনেক ভালবাসি।
- আমি জানি।


খানিক পরেই নিভে যায় মোমবাতি। খাওয়া শেষে ঘুমের প্রস্তুতি চলছে। কি দুর্বিষহ রাত। আঁধারের একা একা। এক বিন্দু আলোও নেই, চারপাশে। প্রচণ্ড একা লাগে। আবার রাত হবার অপেক্ষা। রাত হলে তবেই আবার দুজনের দেখা হবে। আলোটা না কেমন যেন। মোমবাতির চারপাশে একটু একটু বলে, খুব অভিমান ওর। কেন আঁধার পুরো ঘর জুড়ে? আর ও থাকবে মোমবাতি ঘিরে অল্প একটু? দুজনের গল্প করার অবসর বড় কম। ভালবাসার সময় বড় কম।

এই সন্ধ্যার পর, একটু পড়ালেখা করেই, দরজা জানালা বন্ধ করে খেয়ে সবাই ঘুম দেয়। কিইবা হয় একটা রাত পুরোটা সময় মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলে? কিইবা হয়, মোমবাতি না নিভিয়ে ঘুমালে? আলো আর আঁধার তাহলে খুব সুন্দর সারাটা রাত কাটিয়ে দিতেই পারে গল্প করে। হাতে হাত ধরে। সবার অগোচরে একটু আর একটু কাছে থেকে। আঁধারের অনেক ইচ্ছে হয়, একটা রাত আলোর বুকে মাথা রেখে গল্প করবার। সবার সামনে তা করার সুযোগ হয় না। সবাই ঘুমিয়ে গেলেও আঁধার পায় না আলোকে। কষ্ট হয় খুব বিদায় দিতে আলোকে। ব্যাপারটা কষ্টের সত্যি কষ্টের। আলোও মুখ গোমড়া করে চলে যাবার আগে বলে, আমি যাচ্ছি ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে ভুলে থাকা চলবে না।

- ভুলে থাকি না তো।
- হুম মনে থাকে যেন।
- থাকবে মনে।
কষ্টের সময় গুলো শেষে আবার রাত আসে। আলো আর আঁধারের দেখা হয়। সারা রাত আঁধার কি করেছে, শুনে আলো। সারাদিনের হিসেব আঁধার চায় না আলোর কাছে।
আলো বার বার বলে, আমি যদি আর একটু বড় হতাম। আর একটু বেশী তোমার বুকটা জুড়ে থাকতে পারতাম।
- মন খারাপ কর কেন? তোমার ইচ্ছা পূরণ হবে একদিন।

সময় গুলো কেটে যায়। বদলে যায় চারপাশের সব। বদলায় না, এই ঘরের আলো আর আঁধারটার ভালবাসা। মনে হয় প্রতিদিন সেই একই আবেগ, একই ভালবাসা। প্রতিদিনই প্রথম দেখা। প্রতিদিন প্রথম ছোঁয়া। সময়ের পরিবর্তে কাচা ঘরে হয়েছে, পাকা ঘর। মাটির দেয়াল হয়েছে ইটের। মোমবাতি বদলে এখন জায়গা নিয়েছে, এনার্জি বাল্ব। চকচকে ধবধবে সাদা আলো। পুরো ঘরের যেখানে আগে শুধুই আঁধার ছিল। অনেক খুঁজে পাওয়া যেত আলো। এখন পুরো ঘর জুড়েই আলো, অনেক খুঁজেও পাওয়া যায় না একটু আঁধার। আলোর মন বড় ভালো। এখন আর মিটিমিটি করে একটু জায়গায় বসে থাকতে হয় না।

এখন পুরো ঘরেই ওর বিচরণ। যে জায়গা গুলোকে আগে শুধু দূর থেকে দেখত, যাওয়া হত না কাছে। সেসব জায়গায় এখন অনাসায়ে যেতে পারে। খাটের কোণায় ওপাশে একটা ফুলের ছবি আঁকা। আঁধারের বড় পছন্দ ছিল। মাঝে মাঝেই আঁধার এসে গল্প করত। আলোর তা ইচ্ছা করত দেখতে। দেখা হয় নি। কিন্তু এখন ইচ্ছা করলেই দেখতে পারে। বাড়ির এরা এখন আর দ্রুত ঘুমায় না। জেগে থাকে অনেকটা রাত পর্যন্ত। বড় ছেলেটা প্রায় সময় সারারাত জাগে। ছোট মেয়েটা লাইট বন্ধ করে ঘুমাতে পারে না।

তাই আলোর আর চলে যেতে হয় না তেমন করে আগের মত। তবুও এতো ভালোলাগার ভিড়ে আলোর মনে হয় কি যেন নেই। কি যেন হারিয়ে গেছে। মাঝে মাঝেই বড় শূন্য লাগে। আশেপাশে কাউকে খুঁজে। কেউ একজনকে পাশে চায়। সেই কেউ একজন কে তাও জানে আলো। মনে মনেই ভাবে, আঁধার এখন আর আগের মত সময় দেয় না। আশেপাশে আসে না। কোথায় কোথায় যেন থাকে। দেখা হয় না বললেই চলে। আঁধারকে ছাড়া আলোর সত্যি খুব একা লাগে। সেদিন কাঠের আলমারিটার সাথে গল্প করছিল আলো। বলতে বলতেই বলল আলমারিটা, তোমার আঁধার দূরে থাকে কেন জানো?

- কেন?

- এই যে এতো আলো। এর মাঝে তার জায়গা কোথায় বল? তুমিই তো সবটা জুড়ে ঘরের। তবুও জানো, সে বড় ভালো। এই যে সে সড়ে গেল। তোমার জায়গা হল। এতে সে একদম কষ্ট পায় নি। খারাপ লাগে নি। বরং আমার কাছে এসে বলেছিল, দেখো দেখো আমার আলো এখন পুরো ঘর জুড়ে থাকবে। ওর অনেক দিনের ইচ্ছা। ও সত্যি অনেক খুশি থাকবে। বলেই আঁধার মুখ লুকিয়ে চোখ মুছছিল। বুঝতে পারছিলাম, চোখটা ভিজে আসছিল ওর। লুকিয়ে লুকিয়ে জানো, তোমাকে ও এখনও দেখে। ঐ জানালাটার আড়াল দিয়ে। কিন্তু সাহস করে আসে না সামনে। ও আসলেই যে তোমার জায়গা কমে যাবে। সত্যি আঁধার তোমাকে ভালবাসে অনেক।
আলো খানিক সময় চুপ করে থাকে।

পুরো ঘরের দিকে একবার চোখ বুলায়। বুকের ভিতর কেন যেন মোচড় দিয়ে উঠে। শূন্যতাটা সাই সাই করে আরও বেড়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে বুকের ভিতর অনেক ব্যথা। এই ব্যথার জায়গাটা, শূন্যতাটা দূর করবার জন্য আঁধারকে দরকার। নিজেকে বড় স্বার্থপর লাগছে। আঁধারের জায়গাটা দখল করে, কি নিশ্চিন্ত, কি ভাবলেশহীন ভাবে, হাসছে, ভালো লাগাচ্ছে আলো। নিজের উপর রাগ লাগছে খুব। অথচ আঁধার আলোর আবদার পূরণের জন্য, কত সহজে নিজের জায়গাটা ছেড়ে দিল। হাসি মুখে আলোর সুখটার জন্য, দূরে হারিয়ে গেল। আঁধারকে ছাড়া থাকা অসম্ভব।

অসম্ভব থাকা একা একা। একটা উপায় বের করতেই হবে। ঘরে ঢুকল মাত্র বাড়ির বড় ছেলেটা। বিশাল দেহী ছেলে। হাঁটছে ঘরের এপাশ থেকে ওপাশ। আলো গিয়ে পড়ল ছেলেটার গায়ের উপর, একপাশ দিয়ে। অন্যপাশ থেকে সড়ে আসল। অন্যপাশে তাকাতেই একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠল আলোর মুখে। ছেলেটার ছায়ার দিকে তাকিয়েই এই মিষ্টি হাসি। ছেলেটার পুরো ছায়া জুড়ে আঁধার। মুখ গোমড়া করে আছে। আলো বলল, এই কি হল? কথা বলবে না?

আঁধার চোখটা নামিয়ে চুপ করে থাকে। বলে না কিছু। আলো একটু সড়ে এসে, বসে আঁধারের পাশে। গায়ে গা ঘেঁষে।
- বাব্বাহ, এতো অভিমান?
- অভিমান নেই কোন।
- তাহলে কি আছে?
- জানি না।
- ভালবাসা নেই?

আঁধার চুপ করে থাকে।
- বল, নেই?
- আছে।
- তবে মুখ গোমড়া কেন? হাসো একটু। এই যে, এখন থেকে আর দূরে থাকা না। আমি ছায়া বানাব, আর সেই ছায়া জুড়ে তুমি থাকবে। বুঝতেও পারো না একটু তোমাকে ছাড়া কষ্ট হয়?
- বুঝি তো।

- তবে হাত ধর?
আঁধার আস্তে করে ধরে হাত আলোর। আলো হাত ধরেই, ঘরের সব কিছুর উপর একপাশ থেকে পড়ে ছায়া জুড়ে আঁধারকে নিয়ে আসে। আঁধারের হাতটা শক্ত করে ধরে, আলো বলে, আবার অভিমান করে চলে যাবে না তো?
- তুমি তাড়িয়ে না দিলে যাব না।
- এ কি কথা? আমি কেন তাড়িয়ে দেব?
- যদি আর ছায়া না ফেললে?

- যতদিন আলো আছে, ততদিন ছায়া জুড়ে আঁধার থাকবে। আর আঁধার আমাকে অনেক ভালবাসবে।
আঁধার আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে অনেকটা সময়। অনেক কিছু বলতে চায়। অনেক দিনের জমানো কথা। বলার ভাষা পায় না। শুধু আলোর একটু পাশে এসে বলে, একটা কথা বলি?
- বল।

- রাগ করবে না তো?
- আমি তোমার উপর রাগ করি না।
- তোমার বুকে একটু মাথা রাখি?
আলো একটু হেসে বলল, রাখো, এখন থেকে এখানেই থাকতে পারো।
আঁধার চুপ করে শান্ত ভঙ্গিতে মাথা এলিয়ে দিল, আলোর বুকে। বাহিরে আতশ বাজির শব্দ হচ্ছে। হয়ত কোন অনুষ্ঠান। জানালার ধারে গিয়ে দুজন বসে তাকাল বাহিরে। নানা রঙের আলো জ্বলছে। আঁধার বলল, বলেছিলাম না আলো নানা রকম হয়। ঐ দেখো, লাল, নীল, সবুজ , হলুদ।

আলো তাকায় সেদিকে। আঁধার বলে যায়, যাবে নাকি ওখানে?
- একদম না। আমার আঁধারই ভালো। ঐ নানা রঙ লাগবে না।
আঁধার শান্ত চোখে, আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে একটা সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মনের অজান্তে বলে, ভালবাসি।
আলোর কানে তা পৌঁছায় না। আলোও না শুনেই আঁধারের অন্ধকার গালের সাথে গাল লাগিয়ে বলে, সত্যি অনেক ভালবাসি।
ভালবাসতে কি লাগে? প্রশ্নটা বড় কঠিন। অনেক চাহিদার ভিড়ে সবশেষে একটা জিনিস বড় অমূল্য, সেটা হল মনের মিল।

মনের টান। কে কেমন? দেখতে, শুনতে বা কথা বলতে। কিংবা বিপরীত একে অপরের। আলো আঁধারের মত। তবুও আলো আঁধারের মাঝেও একটা বোঝা পড়ার ব্যাপার আছে। আছে মানিয়ে নেবার, মেনে নেবার, মনের মিল করবার টান। এই টানে কাছে থাকাই যায়, ভালবাসাই যায়। সব অমিলের মিল করাতে শুধু মনের মিল দরকার। এক মনের অন্য মনের প্রতি অজানা এক কারণে অদৃশ্য টান দরকার।

লেখক: শেষ রাতের আঁধার

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে