রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:২৫:৪৭

ছিঃ, এভাবে কেউ খায়!

ছিঃ, এভাবে কেউ খায়!

পাঠকই লেখক ডেস্ক : ‘ছিঃ ! এভাবে কেউ খায়’ কথাটা বেশ বিরক্তি নিয়েই বলে তিথী । আমার ভ্রুক্ষেপ নেই । হাত মুড়ি আর চিনি আর নারকেলের মিশ্রনে তৈরি খাবারটার ভেতরে ডুবিয়ে দিব্যি আয়েশ করে খেয়ে চলেছি । প্রথমে ছোট একটা ঠোঙায় দিয়েছিল দোকানী । আমি ওটা রেখে হাত ডুবিয়ে খাওয়া যায় এমন একটা ঠোঙার ভেতরে দিতে বলায় লোকটা কিছুক্ষন ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল । কারণ দশ টাকার মুড়ি কেউ অত বড় ঠোঙায় নিয়ে খায় এই ব্যাপার সে আগে কখনো দেখেনি । আমিও ওভাবে খাইনা । আজ খেতে ইচ্ছে হল । অফিসে যাইনি আজ ।

সকাল বেলায় ঘর থেকে বের হয়েছি কোন কিছু সাথে না নিয়েই । ফোনটাও সাথে নিইনি । হাতে বোঝা বোঝা মনে হবে । বেশ ফুরফুরে মেজাজে ঘন্টা দেড়েক হাটার পর পেটে তৃতীয় এবং চরম মাত্রার ক্ষিধের টের পেলাম । সামনের টুলে কাত হয়ে শুয়ে গেলাম কিছু না ভেবেই । কিছুক্ষন পর দেখি তিথী আসছে । অদূরে মুড়িওয়ালা মুড়ি বিক্রি করছে । মুড়ি নারকেল । আমার পছন্দের খাবার । এসে সামনে দাড়ালে শর্ত জুড়ে দিলাম মুড়ির । বিনিময়ে ডেকেছি কেনো বলবো ।
‘এভাবে খাওয়ার মজা আলাদা । তুমি খাবে?’
‘না স্যার । আমি খাবোনা । আপনিই খান’
‘ওকে’
আমি খাচ্ছি আর আড়চোখে তিথীকে দেখছি । মেয়েটা হাল্কা আকাশী রঙের শাড়ী পড়ে আছে । কপালের ঠিক মাঝখানটায় নীল একটা টিপ বসিয়ে দিয়েছে । চুলগুলি পেছনে সুন্দর করে খোপা বাধা । তিথীর চুল । তিথী জানেনা ও যখন অফিসে বসে থাকে আমি ওর দিকে আড় চোখে তাকাই । ও পাশ ফিরে থাকে বলে ওর চুলের বেশীরভাগ অংশটাই আমার দৃষ্টিগোচর হয় । তিথীর চুল বেশ ঘন । ঘন হলে যা হয় মেয়েদের বেলায় চুল সিল্কী থাকেনা । আর সিল্কি হলে ঘন হয়না । তিথীর চুল একই সাথে ঘন আর সিল্কী । ফ্যানের বাতাসে একগাছি সব সময় কিছুক্ষন পর পর এসে ওর চোখেমুখে পড়ে আর ও ব্যাস্ত হাতে চুল সমালায় ক্ষনকাল পরপরই ।

এখনো তিথীর চোখেমুখে এসে চুল পড়ে আছে । এখন তিথী হাত দিয়ে সরাচ্ছে না । রেগে আছে বোধহয় । তবে প্রকাশ করছে না । প্রকাশ না করলেও আমি বুঝতে পারছি ও রেগে আছে । কারন ওর এপাশের কানটা লাল হয়ে আছে । ওপাশেরটা লাল কিনা বলা যাচ্ছেনা । কারন ওপাশটা দেখা যাচ্ছেনা । ও একবারো ঘার ফেরায়নি । আমি ধীরেসুস্থে খাওয়া শেষ করলাম । হাতটা ঠোঙা দিয়ৈই মুছে পায়ের কাছে ফেলে দিলাম । আমি ঘুম থেকে জেগে পোষাক পাল্টাইনি । রাতে লুঙ্গি আর টি-শার্ট পড়ে ঘুমিয়েছিলাম । সকালে উঠে ওই বেশেই বেরিয়ে পড়েছি । মেয়েটা দাড়াল । চলে যাবে বোধহয় । কথা শোনার ইচ্ছে উবে গেছে । একটা লুঙ্গীপড়া চোখে-মুখে ঘুমের রেশ লেগে থাকা মানুষের সাথে এমন ভাবে পরিপাটি বেশ বসে থাকতে ইতস্তত লাগছে বোধহয় । আমিই বলেছিলাম ওকে এখানটায় আসতে । আমিও উঠে দাড়ালাম । অদূরে পান ওয়ালা পান বিক্রি করছে ।

আমার পান খেয়ে ঠোট লাল করে পানের পিক ফেলতে ইচ্ছে হল । পান ওয়ালার কাছে যেয়ে পান চাইলাম । সে পান দিলে আমি মুখে পুড়ে দিলাম । পয়সা চাইলে বললাম পয়সা নেই । পান ওয়ালা হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো । বোধহয় ভাবছে এ কেমন কথা ! পান পয়সা না থাকলে নিবে কেনো ! লোকটা বোধহয় কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল । থেমেগেল অদূরে তিথীকে দেখে । মেয়েটা এসে ব্যাগ থেকে পানের পয়সা মিটিয়ে দিয়ে হাটা দিলো । আমিও সাথে চললাম । আর কিছুক্ষন পর পানের পিক ফেললাম । মেয়েটার এবারে মেজাজ খারাপ হল ।
‘স্যার আপনার বোধহয় বাসাও যাওয়া উচিৎ । আমি অফিসে গেলাম আপনি বাসায় যেয়ে ফ্রেশ হয়ে অফিসে আসুন ওখানে আপনার কথাটা নাহয় শুনব’ উত্তরের অপেক্ষা না করে হন হন করে হেটে চলে গেল । আমি দাড়িয়েই রইলাম । বেশ কিছুক্ষন পর মুখ থেকে আধ-চিবোনো পানটা ফেলে দিলাম । পিক ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না তাই ।

*
আজ বেশ ধকল গেছে আমার উপর দিয়ে । অফিসে একগাদা কাজ জমেছিল । সেদিন থেকে গতদিন মানে মোট তিন দিন অফিসে আসিনি । আজ এলাম তিন দিন পর । তিনদিনে মোট চারবার খাবার খাওয়া হয়েছে । প্রতিদিন একবার করে । ব্যাতিক্রম ঘটেছিল প্রথম দিন । প্রথম দিন তিথীর কিনে দেয়া নারকেল মুড়ির কারনে একবার বেশী হয়েছে । নইলে তিন দিনে তিনবার হতো । কাজের চাপ এতোই বেশী ছিল যে তিথী আজ কি রঙের শাড়ী পড়ে এসেছিল ভুলে গিয়েছি । আর আজ তিথীর ঘন সিল্কি চুল দেখা হয়নি । দেখার ফুসরতই পাইনি ! সবাই প্রায় চলে গিয়েছে । তিথীও । আমি খেয়াল করিনি কখন বেরিয়ে গেছে । কাজ আরো পড়ে আছে । করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা । বেশ ক্লান্তি লাগছে । এমনিতে আমি সিগারেট খাইনা । সিগারেট ঠিক খাওয়া চলেনা । পান করা চলে । ধুম্রপান । এখন একটা সিগারেট ‘পান’ করতে ইচ্ছে হচ্ছে । নাহ্ , ধুম্রপান করতে ইচ্ছে হচ্ছে । ফাইলপত্র কোনক্রমে গুজে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম অফিস থেকে । আকাশে মেঘ জমেছে বেশ । মৃদু গর্জন সেই সাথে ছিচকে বৃষ্টিও হচ্ছে । আমার ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ।

অদূরের টঙ দোকানের ছাউনির নিচে যেয়ে বসলাম । চায়ের অর্ডার দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে দেখি তিথী আসছে । দোকানী চা দিয়ে গেলে আমি আরো এককাপ বানাতে বলে সরে বসলাম । তিথী ভেতরে এলোনা । বাহিরেই ঠায় দাড়িয়ে রইলো । আমার বলতে ইচ্ছে হলেও ভেতরে আসতে বললাম না । আমিই চায়ের কাপ হাতে বাহিরে দাড়ালাম । চায়ের কাপে বৃষ্টি পড়ছে । আমার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই । আমি তাকিয়ে আছি তিথীর দিকে । আলো-আধারির ভেতরে তিথীকে অসম্ভব রকমের মায়াবতী লাগছিলো । আমি পাগলামিটা ধরে রাখতে পারছিলামনা অনেক চেয়েও । আর লুকোতে পারছিলামনা বোধহয় কিছু একটা । ধরা পড়ে যাবার ভয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম ।
‘বাড়ী যাবেন না?’
‘চা খাবে?’
‘না । আমি বাড়ী যাবো । দেরী হচ্ছে’
‘বৃষ্টি আসবে বোধহয় । ভিজবে?’
‘না । আমার ইচ্ছে নেই । আপনি বাসায় যান । আমিও গেলাম’
মেয়েটা হেটে চলে গেলো । আমি চায়ের কাপটা ফেরত দিয়ে বাহিরে এসে দাড়িয়ে রইলাম । বেশ কিছুক্ষন পর বৃষ্টি এলো । ঝুম বৃষ্টি । আমার ভিজতে ইচ্ছে হচ্ছিল খুব । ইচ্ছে হচ্ছে ভিজতে বাধা কোথায় ! গা এলিয়ে দিলাম ঝুম বৃষ্টিতে ।
একটু সামনে হাটলে দেখতে পেতাম বোধহয় । একটা আবছা ছায়ামূর্তি ভিজছে । দু হাত প্রসারিত করে ভিজতে ভিজতে হেটে যাচ্ছে ।

*
জ্বর এসেছে বোধহয় । বোধহয় না আসলেই জ্বর এসেছে । একেবারে আট-ঘাট বেধে এসেছে । বৃষ্টিতে ভেজার সুফল এটা বোঝার অপেক্ষা রাখেনা । নিজের কপালে হাত দিয়ে নিজেই চমকালাম । আয়নার সামনে দাড়াতে ইচ্ছে হল । যেয়ে ছোটখাট রকমের ভয় পেলাম । এই দশায় কেউ দেখলে নির্ঘাত ভয় পাবে । চোখ রক্তবর্ণ । ঘরে আপাতত খাবার কিছু নেই । বেশ ক্লান্তি লাগছে । চোখ জুড়ে ঘুম আসতে চাইছে ।

কিন্তু কি একটা কারনে আসছেনা । তিথী । তিথী আমার আর ঘুমের মাঝখানটায় দাড়িয়ে । অনেকটা ঘোরের ভেতরেই যেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম । তিথীর বাতাসে উড়ন্ত চুলে এলোমেলো মুখটা ভাসছে চোখের সামনে । ঘোর কাটল ফোনের ভাইব্রেশনে । তিথীর নামটা ফোনের স্ক্রীনে ভাসছে ।
‘কিছু খেয়েছেন ?’
‘না । ক্ষিধে নেই’
‘আপনার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন কি হইছে?’
‘আমার কিছু হয়নি । আমি এখন ঘুমুব । গুডনাইট’
জবাবের অপেক্ষা না করে ফোনটা কেটে দিলাম । ঘুম আসছেনা । চোখ দুটো জ্বলছে । মনে হচ্ছে কেউ বোধহয় মরিচ ঢেলে দিয়েছে । আবার ঘোরে পড়েগেলাম ।
*
দড়জায় কড়া নাড়ানোর শব্দ হচ্ছে খুব । আমার ঘোর-ঘুম দুটোই ছুটে গেল । উঠে দড়জা খুলে দেখি তিথী দাড়িয়ে । পড়নে হাল্কা সেই আকাশী রঙের শাড়ী । হাতে টিফিন ক্যরিয়ার ।
বাহিরে এখনো বৃষ্টি হচ্ছে টিপটিপ ।
‘এতো রাতে তুমি এখানে !’
‘রাত এখনো খুব বেশী হয়নি । আমি খাবার নিয়ে এসেছি খেয়ে নিন’
‘আমার ক্ষিধে নেই’
‘আপনার ক্ষিধে না থাকলেও খাবেন । এবং অবশ্যই খাবেন’
‘তোমার কথা আমি শুনতে যাবো কেনো ! তুমি কে হে আমার ?’
কথাটা লাগলো বোধহয় । ঝট করে মাথাটা নিচু করে ফেললো ।
‘খাবারটা রেখে গেলাম ইচ্ছে হলে খেয়ে নেবেন । আর নইলে সকালে টিফিন ক্যারিয়ারটা সহ ডাস্টবিনে ফেলে দেবেন’
চোখের জলটা বোধহয় দেখাতে চায়নি । একরকম ছুটেই বেরিয়ে গেল । ওসব ভাবার সময় পরেও পাওয়া যাবে । আপাতত ক্ষিধে মেটানো প্রয়োজন । এই জ্বরের ভেতরেও ক্ষিধের টের পাচ্ছিলাম । খুলে খেয়েনিলাম ।

পেছনের জানালায় তাকালে দেখতে পেতাম ওটার পর্দায় একটা ছায়ামূর্তির কায়া পড়েছে । আর জানালাটা খুললে হয়তো দেখতে পেতাম কায়ার মালিক চোখ মুছছে আর গাল ফুলাচ্ছে । তার চোখে একগাছি ভেজা চুল এসে পড়ে আছে । সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই । সে অবিরাম চোখ মুছেই চলেছে ।

*
হাতের কাগজের মলাটটা বেশ শক্ত । ভাঁজ করে রেখে দিলে আপার আপনা আপনিই সোজা হয়ে যাচ্ছে । বিরক্ত হয়ে ভাঁজ করে ওটার উপর পেপারওয়েট বসিয়ে দিলাম একটা । কাজ আপাতত শেষ । চেয়ারটায় বসে দোল খাওয়া ছাড়া আর কাজ নেই । বসে থাকটা বিরক্তিকর লাগছে । কারন সামনের কেবিনটায় তিথী নেই । আজ আসেনি অফিসে । গত দুদিন আসেনি । আজকেও আসেনি । ফোনটা বের করে নাম্বারটায় ডায়াল করতে যেয়ে আবার রেখে দিলাম । কিছু কি বলার আছে ? আছে । একটা কিছু বলার আছে । ভাঁজ করা কাগজটার উল্টোপিঠে খসখস করে একটা কিছু লিখলাম । ওটা তিথীর কেবিনের টেবিলটায় পেপারওয়েট দিয়ে চেপে বেরিয়ে গেলাম । আগামি দুদিন আর আসবোনা অফিসে । আমার জ্বর থাকবে ।

*
‘টেবিলের উপর কাগজটা কে রেখেছে?’ মৃদু কন্ঠটার রেশটা কানে যেতেই তন্দ্রা ছুটে যায় ।
‘আমি কি করে জানবো?’ আকাশ থেকে পড়া ভঙ্গী আপনা আপনিই চলে আসে । আর সেই সাথে চোয়ালের হায়ের আকৃতি বৃদ্ধি তো আছেই !
‘তাহলে কি আমার পাশের কেবিনের ভদ্রলোক রেখেছেন? তবে যাই , তার কাছেই যাই’
উঠে যাবার উপক্রম করতেই তন্দ্রা একেবারে ছুটে গেল আমার ।
‘আর কতোটা বুঝতে হবে আমার?’
‘জানা নেই’
‘জানতে হবে । আমার সবটা জানতে হবে’
দরজাটা খুলে বের হলাম । কি মনে করে ফিরে এলাম আবার । তিথী সামনে এসে দাড়াল । আমি ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম ।
‘তোমার ঘুমে স্বপ্ন আমি দেখেছি একলা রাতে
হবে কি ভোর তুমি আমার
আলো নিত্য প্রাতে?’
ছোট্র একটা জবাব পেলাম । ওটার প্রতীক্ষাতেই হয়তো ছিলাম ।
হাজার বছর ধরে প্রেমিকেরা ওটার প্রতীক্ষাই করে এসেছে । যতোদিন প্রেম বলে কিছু থাকবে ততোদিন করেই যাবে ।

লেখক: অষ্টাদশীর স্বপ্নদ্রষ্টা
 

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে