রবিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১০:২৮:৫৬

রূপালী দিনের ভালোবাসা

রূপালী দিনের ভালোবাসা

পাঠকই লেখক ডেস্ক : কেবল মেট্রিক পাশ করেছে রাশিদা, তাতেই আর তর সইলো না তার আব্বার। হুট করেই বিয়েটা দিয়ে দিল তার। পাত্র নাকি খুবই ভালো,উচ্চশিক্ষিত। তাই মেয়ের আর পড়াশুনা না করলেও চলবে।তাছাড়া মেয়েমানুষ অত পড়াশুনা করে করবে টাই বা কি!এসবই ঘটক বুঝ দিয়েছে তার আব্বাকে। রাশিদার আর কিছুই বলার ছিলো না।আব্বাকে যমের মত ভয় পায় সে।আব্বার উপর আজ পর্যন্ত কেউ কথা বলার সাহস পায় নি।

আব্বা-আম্মার একমাত্র মেয়ে এবং সর্বকনিষ্ঠ সন্তান রাশিদা।তবুও ভাইদের আগেই তার বিয়েটা দেয়া হলো,কারণ মেয়েদের নাকি বেশিদিন ঘরে বসিয়ে রাখতে নেই। বিয়ের দিন রাশিদা সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছে তার আব্বাকে কাঁদতে দেখে। যে মানুষটাকে সারাজীবনে কেউ কাঁদতে তো দূরে থাক,একটু মন খারাপও করতে দেখে নি;শুধু তার রাগটাই দেখে গেছে,সেই মানুষটার কান্না দেখে সেদিন আরো অনেকেই চোখের পানি আটকাতে পারে নি। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রাশিদার মনে হয়েছিল- তার আব্বা মানুষটা অন্তত কোনো ভুল মানুষের হাতে তাকে তুলে দেন নি।

তখনই রাশিদা ঠিক করে ফেলেছিল তার স্বামী মানুষটাকে এখন থেকে সে নিজের জীবন দিয়ে হলেও সেবা করে যাবে।সেবার মধ্য দিয়েই নাকি নারীর ভালবাসা প্রকাশ পায়,কথাটা আম্মা তাকে বলেছে।বিয়ের আগের রাতে যখন সম্পূর্ণ অপরিচিত এক লোকের সাথে সংসার নামক যুদ্ধে অবতরণ করার চিন্তায় অস্থির হয়ে বারবার সে ঘেমে নেয়ে উঠছিলো,তখনই আম্মা তাকে ডেকে নিজের কাছে বসিয়ে বলেছিলেন- "শুন রাশিদা,এত ভয় পাওয়ার মতন কিছু হয় নাই।বিয়া আজ নয়্তো কাল করাই লাগবে। সবসময় শুধু মনে রাখবি,স্বামীর সেবা করাই মেয়েলোকের ধর্ম।

তাতেই তর প্রেম প্রকাশ পাবে। স্বামীর সাথে উতরাউতরি করবি না। যা বলে তাই শুনবি। গায়ে হাত তুললেও সহ্য করি নিবি। মেয়ে হইলে অনেক কিছুই সহ্য করা লাগে।" এসব শোনার পর তার ভয় কমার বদলে উল্টো আরও বেড়ে গিয়েছিলো।তবুও কথাগুলো সে মনে গেঁথে নিয়েছে। এখন থেকে এভাবেই চলবে সে। আজহারুলের ছুটির আজকেই শেষদিন।কাল থেকে আবার অফিসে যেতে হবে।বিয়ের জন্য দিন পাঁচেকের ছুটি নিয়েছিল সে।

ছুটি শেষ হওয়ায় তাই আজই রাশিদাকে নিয়ে রায়্গঞ্জে চলে এসেছে।এখানেই তার অফিস। প্রথম প্রথম সবকিছু গুছিয়ে নিতে রাশিদা একটু হিমশিমই খেয়ে গেল।তবে অল্পকিছুদিনের মধ্যেই সব ঠিকঠাকভাবেই গুছিয়ে আনলো। সবকিছু ভালোভাবেই চলছে,শুধু একটা একাকীত্ব মাঝে মাঝে খুব বেশি জেঁকে ধরে রাশিদাকে। তার স্বামী অনেক সকাল সকাল বেড়িয়ে পড়ে অফিসের জন্য।তারপর সারাটাদিন তাকে একা একাই কাটাতে হয়।কথা বলারও একটা মানুষ নেই এখানে। রাতে তার স্বামী ফিরে এসে খেয়েদেয়েই শুয়ে পড়ে।

খেলা থাকলে হয়্তো কিছুক্ষণ রেডিও শুনে নইলে শোয়ার পরপরই ঘুম। কেমন যেন মানুষটা,বেরসিক।একটু গল্পগুজবও করতে জানে না।চুপচাপ থাকতেই বেশি পছন্দ করে। কিন্তু রাশিদার মাঝে মাঝে দম বন্ধ হয়ে আসে। সে বরাবরই গল্প করতে অনেক ভালবাসে।অথচ তার সাথে কথা বলার কিংবা তার কথা শোনার মত একটা মানুষ নেই এ বাসায়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে গলা ছেড়ে কাঁদতে।তখনই মায়ের কথাগুলো মনে পড়ে।তাই ঢোক গিলে কান্নার দমক টাকে ওখানেই গলা টিপে মেরে ফেলে। তাছাড়া যে বাড়িতে মেয়ে মানুষের চোখের জল পড়ে সে বাড়ির নাকি অমঙ্গল হয়।

(2)
সে চায়্না তার স্বামীর কিংবা তার সংসারের কোনো অমঙ্গল হোক। তবুও সে-ও তো মানুষ।কখনও কখনও রেডিওটাকে তার নিজের সতীন বলে মনে হয়।যত মনযোগ দিয়ে তার স্বামী রেডিওতে কান লাগিয়ে বসে থাকে ততটা মনযোগ যদি একবার তার দিকে দিত! এই রেডিওটাই যত নষ্টের মূল।রাশিদার তো ইচ্ছে করে একবারে আছড়ে ওটাকে ভেঙ্গে ফেলতে। কিন্তু মেয়েমানুষের এত তেজ থাকতে নেই। মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়ার সাথে সাথেই জন্মগতভাবে একটা শিকল পরে এসেছে সে।হাত পা বাঁধা তার।

তাই চাইলেও অনেক কিছুই করতে পারে না। সারাদিন কত আর একা একা থাকা যায়!কাজ শেষ করেও অনেকক্ষণ একা থাকতে হয় তাকে। তাই সময় কাটানোর একটা উপায়ও বের করেছিল সে। সেই অনেকদিন থেকেই একটা গ্রামোফোনের খুব শখ তার।জিনিসটা থাকলে ভালোই হত,গান শুনে সময়্টাও কেটে যেত তার। রাশিদা চেষ্টা করেছিল আড়ালে আবডালে তার স্বামীকে বুঝানোর।কিন্তু মানুষটা এক কথায় না করে দিয়েছে। বলেছে, তার নাকি ওসব ভালো লাগে না। মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে রাশিদা,কিন্তু বুঝতে দেয় নি।বিয়ের পর এই প্রথম একটা কিছুর শখ করেছিল সে।
কিনে দেয়ার মত সামর্থ্য যে নেই তাও না।তবুও মানুষটা বুঝলো না।থাক সে আর কিছু বলবে না।

আজহারুলের আজ বাসায় ফিরতে দেরী হবে। রাশিদাকে অবশ্য বলে এসেছে সে যে আজ অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি থাকবে। মেয়েটা সারাদিন একা একা থাকে,সত্যিই বুঝি খুব কষ্ট হয় তার।কত কষ্ট করেই না আড়ালে আবডালে একটা গ্রামোফোনের জন্য আবদার করার চেষ্টা করেছিল। সে অবশ্য মুখের উপর বলে দিয়েছে যে ওসব তার একদম পছন্দ না। মেয়েটা বেশ কষ্টই পেয়েছে বোধহয়।কথাটা শোনার সাথে সাথেই মুখটা কেমন পেঁচার মত বানিয়ে রেখেছিল।কেন যেন আজহারুলের খুব হাসি পেয়েছিল তখন।তবু মুখটা গম্ভীর করে রেখেছিল সে। বউকে নাকি বেশি প্রশ্রয় দিতে নেই।তাহলে একের পর এক আবদার করতেই থাকবে।

তার বিবাহিত বন্ধুদের দীর্ঘদিনের গবেষণার ফল থেকেই তারা তাকে এই উপদেশ দিয়েছে।বিয়ের পর থেকে অক্ষরে অক্ষরে তাই পালন করার চেষ্টা করে চলছে সে। আজহারুলের আজ বাড়ি ফিরতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেল।মেয়েটা বোধহয় এতক্ষণে ঘুমিয়েই পড়েছে। বাড়ি ফিরে দেখলো যা ভেবেছে তাই,রাশিদা ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাগ্যিস দুটো দরজার একটাতে তালা দিয়ে চাবি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল সে। বাসার ভেতরে ঢুকতেই দেখতে পেল টেবিলে খাবার রেখে মেয়েটা টেবিলেই মাথা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

কেন যেন এই ছোট্ট মেয়েটার জন্য হঠাৎ খুব মায়া লাগলো তার।বুকের ভেতর কোথায় যেন ধ্বক করে উঠলো। পরদিন সকালে উঠে স্বামীকে পাশে না দেখে খুব অবাক হলো রাশিদা।আজ কি একটু বেশি ই ঘুমিয়ে ফেলেছে নাকি? হঠাৎ কাল রাতের কথা মনে পড়লো তার। সে তো টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল,তাহলে বিছানায় এলো কি করে! মানুষটা কি তবে. . !

রাশিদার খুব লজ্জা করতে লাগলো হঠাৎ। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেড়িয়েই অবাক হয়ে গেল সে। টেবিলের উপর একটা গ্রামোফোন রাখা,সাথে একটা চিঠি। একমুহূর্ত ভাবলো রাশিদা,তারপরেই চিঠিটা খুলে পড়তে শুরু করলো সে-
"রাশিদা,
দেখো তো পছন্দ হয়?ভেবে দেখলাম সারাদিন তুমি একা থাক,তাই তোমার জন্য নিয়ে এসেছি কাল। আর শুনো,আমি কিন্তু এতটা চুপচাপ না।বন্ধুদের পরামর্শে একটু গম্ভীর থাকার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমার মত বাচাল লোকের পক্ষে তা আর সম্ভব না। দেখো তো,কিসব লিখছি! আসলে এর আগে কাউকে এভাবে চিঠি লিখি নি তো তাই।কেমন যেন লজ্জা করছে জানো?আমি না কাল দুম করে ছুটি নিয়ে বসেছি। অফিসের সবাই কেমন যেন মিটমিট করে হাসছিলো। যাক সে কথা,আজ একটু হাঁটতে যাবে আমার সাথে? বাইরেই দাঁড়িয়ে আছি আমি।"


চিঠি পড়তে পড়তে রাশিদার গাল লাল হয়ে গিয়েছে। ইশ মানুষটার কি আক্কেলও নেই নাকি। এভাবে লজ্জা দিতে হয়! এর শোধ নিবেই সে। মানুষটাকে সে-ও লজ্জা দিবে,গুণে গুণে দুইবার।

লজ্জায় লজ্জায় কাটাকাটি।

লেখক : অভিমানী রাজকন্যা

Follow করুন এমটিনিউজ২৪ গুগল নিউজ, টুইটার , ফেসবুক এবং সাবস্ক্রাইব করুন এমটিনিউজ২৪ ইউটিউব চ্যানেলে