দেশে কিছুদিন ধরেই শিশু নির্যাতন ও হত্যার একের পর এক ঘটনা ঘটছে। বর্বর নির্যাতন চালিয়ে একাধিক শিশুহত্যার ঘটনার পর এবার এই দুই কিশোরীকে হত্যা করা হলো। সাম্প্রতিক সময়ে একসঙ্গে দুই কিশোরীকে এভাবে হত্যার ঘটনা দেখা যায়নি।
গতকাল বৃহস্পতিবার ঘটনার শিকার দুই ছাত্রী হলো সুমাইয়া আক্তার ও হ্যাপি আক্তার। তাদের বয়স মাত্র ১৪। দুজনই মাদারীপুর সদর উপজেলার মোস্তফাপুর গ্রামের বাসিন্দা এবং মোস্তফাপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় শিপন শিকদার (১৮) ও রফিক শিকদার (২১) নামের দুই যুবককে আটক করেছে পুলিশ।
নিহত শিক্ষার্থীদের দুই পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সুমাইয়া ও হ্যাপি গতকাল বেলা তিনটার দিকে কোচিং করতে বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে স্কুলের উদ্দেশে বের হয়। পরে বিকেল চারটা থেকে সোয়া চারটার মধ্যে ১৮ থেকে ২২ বছর বয়সী চারজন যুবক তাদের অচেতন অবস্থায় মাদারীপুর সদর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে আসেন বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ও কর্মচারীরা বলেছেন, সুমাইয়া ও হ্যাপিকে নিয়ে এসে চার যুবক প্রথমে জানান যে তারা বিষ খেয়েছে।
প্রাথমিক চিকিৎসা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যে বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে হ্যাপি মারা গেলে ওই চার যুবক পালিয়ে যান। এরপর সেখানে শিপন শিকদার ও রফিক শিকদার নামে দুই যুবক উপস্থিত হলে হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা তাদের আটক করে পুলিশে খবর দেন। পরে পুলিশ ওই দুজনকে আটক করে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সুমাইয়া মারা যায়। এরপর দুই পরিবারের সদস্য, স্বজন ও প্রতিবেশীরা খবর পেয়ে হাসপাতালে আসেন।
সুমাইয়ার বাবা বিল্লাল শিকদার মোস্তফাপুর বাসস্ট্যান্ডে চা বিক্রি করেন। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সুমাইয়া বড়। সুমাইয়ার বাবা জানান, আটক দুই যুবক সুমাইয়াকে উত্ত্যক্ত করতেন। বিষয়টি তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য মিন্টু শিকদারকে জানিয়েছিলেন। তাঁর অভিযোগ, ধর্ষণের পর মুখে বিষ ঢেলে সুমাইয়াকে হত্যা করা হয়েছে।
একই অভিযোগ করে হ্যাপির মা মুক্তা বেগম বলেন, আটক হওয়া রফিক তার মেয়েকে উত্ত্যক্ত করতেন। বিষয়টি তিনিও মিন্টু শিকদারকে জানিয়েছিলেন। তিন বোনের মধ্যে হ্যাপি বড়। তার বাবা হাবিব খান বাহরাইনপ্রবাসী।
সুমাইয়া ও হ্যাপির মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে রাত আটটার পর হাসপাতালে উপস্থিত হন মিন্টু শিকদার। তিনি বলেন, দুই পরিবারের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর তিনি শিপনের বাবা কুদ্দুস শিকদার ও রফিকের বাবা কামাল শিকদারকে এ বিষয়ে সতর্ক করেন। আর দুই মেয়ের অভিভাবকদের আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দেন।
হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক শফিকুল ইসলামের ভাষ্য, সুমাইয়ার শরীরে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন থাকলেও হ্যাপির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই। আজ শুক্রবার লাশ দুটোর ময়নাতদন্ত হবে। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার আগে ধর্ষণের বিষয়ে কিছু বলা যাচ্ছে না।
কিশোরী দুটির লাশের সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাদারীপুর সদর থানার একজন উপপরিদর্শক (এসআই)। পরে রাত সোয়া ১১টার দিকে প্রথম আলোকে তিনি বলেন, সুমাইয়ার গলা, হাত ও পায়ের আঙুলে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। হ্যাপির শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন নেই।
জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার উত্তম কুমার পাল একই সময়ে জানান, ‘মেয়ে দুটি কীভাবে মারা গেল জানার জন্য আমরা আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। যাঁরা মেয়ে দুটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, তাঁদের পরিচয় জানা গেছে। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না।’
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউল মোর্শেদ বলেন, আটক দুই যুবককে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাঁরা এরই মধ্যে তদন্ত শুরু করে দিয়েছেন।
সুমাইয়া ও হ্যাপিকে শান্তশিষ্ট স্বভাবের উল্লেখ করেন মোস্তফাপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বোরহান খান। তিনি এ ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেন। এ জন্য স্কুলের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলেও জানান তিনি।
রাত সাড়ে আটটার পর মাদারীপুর সদর হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, জরুরি বিভাগের পাশে একটি কক্ষের মেঝের ওপর দুই কিশোরীর লাশ পড়ে আছে। খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন তাদের স্কুলের শিক্ষক ও প্রতিবেশীরা। স্বজনদের আহাজারিতে তাঁদের অনেকেই কান্না সামলে রাখতে পারেননি।
পৌনে নয়টার দিকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মোহাম্মদ জাকি সেখানে উপস্থিত হন। মধ্যরাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সবাই হাসপাতালে অবস্থান করছিলেন। -প্রথম আলো